বাঙ্গালী
Monday 25th of November 2024
0
نفر 0

ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশ

শফিউল আলম : মৃদু থেকে হালকা ও মাঝারি ধরণের ভূকম্পন মাঝে-মধ্যেই অনুভূত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভূ-পাটাতন (টেকটোনিক প্লেট) ও ভূ-ফাটল (ফল্ট) লাইনগুলো একযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক এই প্রবণতা বা প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞগণ যে কোন সময়ই বাংলাদেশসহ আশপাশ অঞ্চলে শক্তিশালী এমনকি প্রলয়ংকরী মাত্রায় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে এমনটি জোরালো আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। সম্ভাব্য তীব্র ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকির আওতায় রয়েছে দেশের সর্বাপেক্ষা ঘনবসতিপূর্ণ মধ্যাঞ্চলসহ বৃহত্তর ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চল।
এদিকে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) এক জরিপ ফলাফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকির ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে উদ্বেগজনক অবস্থার চিত্র। এতে জানানো হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিংবা কাছাকাছি জায়গায় কোন উৎপত্তিস্থল (ইপি সেন্টার) থেকে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও সিলেট নগরীর কমপক্ষে ২ লাখ ৫০ হাজার ভবন কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধসে পড়তে পারে। প্রাণহানির আশংকা রয়েছে এক লাখেরও বেশি মানুষের। জরিপ তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকায় ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবনের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৭৮ হাজার ভবন অপরিকল্পিত, ভূমিকম্প প্রতিরোধক কারিগরি ব্যবস্থাবিহীন, নির্মাণে গুরুতর ত্রুটিযুক্ত ও এসব কারণে ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। চট্টগ্রাম মহানগরীর চালচিত্র আরও নাজুক। চট্টগ্রামে জরিপকৃত ১ লাখ ৮০ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবনই নানাবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ। সিলেট নগরীর ৫২ হাজার ভবনের মধ্যে ২৪ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে জরিপে শনাক্ত করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই সতর্ক করে আসছেন, সুপ্ত মনে হলেও বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের সিসমিক (ভূতাত্ত্বিক) অবস্থান ভূমিকম্পের সক্রিয় জোনেই রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসব অঞ্চলের পাহাড়-পর্বত-টিলা, বন-জঙ্গল, জলাভূমি, হ্রদ, নদ-নদী ইত্যাদি সব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সুরক্ষা করা জরুরি। অন্যথায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপন্ন হয়ে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বেড়ে যাবে।
ভূ-ফাটলে অস্থিরতা
বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার এই ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকায় এবং এর সন্নিহিত ভূটান নেপাল, চীনসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঘন ঘন মৃদু, হালকা ও মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, এ অঞ্চলে সহসা যে কোন সময়ই সম্ভাব্য শক্তিশালী ভূমিকম্পের আগে বর্তমান সময়ে এ ধরনের উপর্যুপরি ভূকম্পনগুলোকে প্রি-শক, ‘ওয়েক আপ কল' কিংবা আগাম সংকেত ও বড় ধরনের বিপর্যয়ের পদধ্বনি হিসেবেই দেখতে হবে। ইন্দো-বার্মা-হিমালয়ান, ইউরেশীয় একাধিক ভূ-ফাটল লাইনের বিস্তার ও অব্যাহত সঞ্চালনের কারণে এ অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পন বলয় হিসেবে চিহ্নিত। বার বার ছোট বা মাঝারি মাত্রায় ভূকম্পনের কারণে এ অঞ্চলের ভূ-ফাটল লাইনগুলো নাজুক ও শিথিল হয়ে পড়েছে। যা অদূর ভবিষ্যতে প্রবল ভূমিকম্পের আলামত বহন করে। তাছাড়া একশ'-দেড়শ' বছর অতীতে এ অঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮ মাত্রায় তীব্রতাসম্পন্ন ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল।
পৃথিবীর ভূ-কম্পনপ্রবণ এলাকাগুলোতে সাধারণত ৫০, ৭০, ১০০, ১৫০ বছর অন্তর শক্তিশালী ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাংলাদেশ ও এর সন্নিকটে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূকম্পন প্রবণ অঞ্চলে বিগত ১৫০ বছরে রিখটার স্কেলে ৭ ও ৮ মাত্রায় ৭টি ভূমিকম্প এবং একাধিক ভয়াল সুনামি আঘাত হানে। এর মধ্যে ২টির উৎপত্তিস্থল (ইপি সেন্টার) ছিল বাংলাদেশ ভূখ-ের ভেতরেই এবং অপর ৫টির উৎস ছিল রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ২৫০ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে। পার্বত্য অঞ্চল তথা স্থলভাগ ছাড়াও সাম্প্রতিককালে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন আন্দামান নিকোবরে দফায় দফায় ভূকম্পন হয়েছে। বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চল, ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর, বগুড়া, বৃহত্তর চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত।
অপরিকল্পিত নগরায়ন
সম্ভাব্য প্রবল ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উচ্চঝুঁকির অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের এক জরিপ প্রতিবেদনে জানা যায়, মহানগরীর পুরনো এলাকাসমূহ এবং অপরিকল্পিত নগরায়নে বর্ধিষ্ণু উভয় এলাকায় ঝুঁকির মাত্রা তুলনামূলক বেশি। পাহাড়-টিলা নির্বিচারে কেটে ও জলাভূমি রাতারাতি ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে যেসব ভবন যত্রতত্র নির্মাণ করা হয়েছে এর উল্লেখযোগ্য অংশই বিধ্বস্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। নগরীর আলকরণ, ফিরিঙ্গি বাজার, পাথরঘাটা, পাঠানটুলি, মোগলটুলি, আন্দরকিল্লা, পুরনো ও নয়া চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, মাদারবাড়ী, সদরঘাট, মাঝিরঘাট স্ট্র্যান্ড রোড, ঘাটফরহাদবেগ, চকবাজার, সিরাজুদ্দৌলাহ রোড, রহমতগঞ্জ, জামাল খান লেইন, আসকারদীঘি এলাকা, আগ্রাবাদ, কদমতলী, ষোলশহর, দেওয়ানহাটের বেশকিছু এলাকায় জরাজীর্ণ দুর্বল কাঠামোর বাড়ীঘর, দোকান-পাট, গুদামের একাংশ ৭ মাত্রার ভূকম্পনে ধসে যেতে পারে।
তাছাড়া নাজুক ভূমির ওপর গড়ে ওঠা ঘরবাড়ি, কারখানা, বহুতল ভবন ভূকম্পনে ভারসাম্য হারিয়ে ক্রমাগত নিচের দিকে দেবে যেতে পারে। উপযুক্ত সয়েলটেস্ট এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধক কারিগরি পদ্ধতি, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-১৯৯৩ ইত্যাদি নিয়ম-বিধি লঙ্ঘন বা উপেক্ষা করেই অনেক ভবন নির্মিত। এ কারণেও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে সংঘটিত ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিবিরহাট হামজারবাগে ‘সওদাগর ভিলা' ট্র্যাজেডি তার অন্যতম প্রমাণ। যথেচ্ছ অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত সেই ৬ তলা ভবন মাঝারি ভূমিকম্পের ধাক্কায় বিধ্বস্ত ও দেবে গিয়ে ভবনটির বাসিন্দা ২৩ জন নর-নারী, শিশুসহ নিরীহ মানুষ শোচনীয়ভাবে প্রাণ হারায়।
অতিমাত্রায় শক্তি সঞ্চয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. খলিল চৌধুরী তার এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্পই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন, আতঙ্কদায়ক ও অপ্রত্যাশিত। জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় সর্বাপেক্ষা বেশি ধ্বংসাত্মক। ভূমিকম্প হঠাৎ করেই সংঘটিত হয়ে থাকে। এর প্রত্যক্ষ বা সঠিক পূর্বাভাস প্রদানের প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত উদ্ভাবনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে পরোক্ষ কিছু লক্ষণ থেকে কখনো বা কোথায়ও আগাম সতর্ক বার্তা পাওয়া যায়। কোন এলাকায় উপর্যুপরি স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প অধিক শক্তিশালী ভূমিকম্পের আভাস হতে পারে। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের অনেক কারণ রয়েছে। তবে প্রাকৃতিক কারণে সংঘটিত ভূমিকম্পের শতকরা ৯০ ভাগই হয়ে থাকে ভূ-সাংগাঠনিক প্লেট বা টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল এবং ভূত্বকের ফাটল বরাবর সক্রিয়তার কারণে। ভূপৃষ্ঠে যে ১২টি বড় ধরনের ভূ-সাংগাঠনিক প্লেট রয়েছে এর মধ্যে ভারতীয় প্লেট অন্যতম।
ভারতীয় প্লেটের সীমানা বা হিমালয় অগ্রবর্তী বলয় পশ্চিমে আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভূটান, ভারতের অরুণাচল প্রদেশে অর্ধবৃত্তাকারে মোড় নিয়ে দক্ষিণে নাগারাজ্যের উপর দিয়ে আরাকান উপকূল হয়ে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতীয় ও এশীয় প্লেট দু'টির এই সংযোগস্থল এবং এই অঞ্চলে সৃষ্ট ভূত্বকের অন্যান্য ফাটলগুলোতে প্রায়ই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
ড. খলিল চৌধুরী উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ও সংলগ্ন অঞ্চলে যেসব ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা রয়েছে তার মধ্যে হিমালয় অগ্রবর্তী বলয়, নাগা-ডাইসং-হাফলং ঘাত, ডাউকি চ্যুতি, মধুপুর চ্যুতি, সীতাকুন্ড টেকনাফ-আন্দামান অধোগামী বলয়, কালাদান চ্যুতি বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য। এসব এলাকায় গত আড়াইশ' বছরে এক শতাধিক মাঝারি থেকে উচ্চ ক্ষমতার ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১২টি ছিল উচ্চ শক্তিসম্পন্ন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরে ভূকম্পনের পৌনঃপুনিকতা বেড়ে গেছে। ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে বৃহত্তর জেলা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশ, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর এবং দিনাজপুরের উত্তরাংশ। মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে কুমিল্লা, ঢাকা, রাজশাহী ও কুষ্টিয়া। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, এশীয় প্লেটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কারণে ভারতীয় প্লেটে গত কয়েক দশক ধরে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি সঞ্চিত হয়েছে। সঞ্চিত শক্তি নিঃসরণ বা অবমুক্ত হওয়ার সময়ই ঘটে ভূমিকম্প। সুমাত্রার ভয়াল ভূমিকম্প ও সুনামি এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের কারণে সীতাকুন্ড-টেকনাফ-আরাকান-আন্দামান অধোগামী বলয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষণ পাওয়া যায়। এ কারণে কক্সবাজার-টেকনাফ উপকূলে খাদ সৃষ্টিসহ কোন কোন এলাকা ভাঙনের কবলে পড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে ভারতীয় প্লেটের উত্তর-পূর্বাংশে সঞ্চিত শক্তি অদূর ভবিষ্যতে বিমুক্ত বা সঞ্চালন হওয়ার আশংকার কথা ভেবে বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

আনসারুল্লাহ'র দখলে সৌদি আরবের ...
২৮০ জন শরণার্থীকে সমুদ্রে ...
সন্ত্রাসবাদ রুখতে ঐক্যবদ্ধ ...
মিলাদুন্নবী, জুমাতুল বিদা সহ ১৭ ...
সেনা নিহতের কথা স্বীকার করল সৌদি ...
স্বচ্ছ চুক্তি চাই যা ইরানের ...
বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার জবাবে আশ ...
খোদায়ি বিধানেই ফিলিস্তিনের ...
নাইজেরিয়ায় বিমান হামলায় বোকো ...
ফ্রান্সে জনতার ওপর ট্রাক নিয়ে ...

 
user comment