আবনা : ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ, অস্থিরতা, জঙ্গীবাদ এবং রাশিয়া, ভেনিজুয়েলা ও ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ ইত্যাদি কারণে তেলের দাম এই বছরে আকাশচুম্বী হওয়ার কথা ছিল। এতে নিঃসন্দেহে ধস নামত মার্কিন ও ইউরোপীয় অর্থনীতিতে।
বিশ্লেষকদের অভিমত অনুসারে- চলমান অস্থিতিশীলতার কারণে অপরিশোধিত তেলের দর ব্যারেল প্রতি ১৫০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারত। শোচনীয় হয়ে পড়ত পাশ্চাত্যের অর্থনীতি, উন্নত বিশ্বে সৃষ্টি হতো প্রবল রাজনৈতিক চাপ। ফলে বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান হতো কিন্তু এটা জেনেই সৌদি সরকার বিশ্ববাজারে তেলের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে এবং এর ফলে তেলে দরে ধস নেমেছে। তেলের বর্তমান দাম ব্যারেল প্রতি ৬০ ডলারেরও নিচে নেমে এসেছে যা সত্যিই বিস্ময়কর।
তেলের দাম পানি দরে নিয়ে আসার অন্যতম ভূমিকায় নেমেছে তাকফিরি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইএসআইএল। অবশ্য মূলত এ উদ্দেশ্যেই আইএসআইএলকে সৃষ্টি করেছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব ও সৌদি আরব- এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। গত বছরের মাঝামাঝিতে আইএসআইএল এক প্রকার কোনো বাধা ছাড়াই দ্রুত ইরাক ও সিরিয়ার তেল ক্ষেত্রগুলো দখল করে নেয় এবং ওই কুপগুলো থেকে তেল উত্তোলন করে তুরস্ক ও ইসরাইলের মাধ্যমে কালো বাজারে স্বল্পমূল্যে তেল বিক্রি করতে থাকে।
অন্যদিকে ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে সৌদি পলিসি ব্যর্থ হওয়াতে ইরান ও রাশিয়ার উপর প্রচণ্ড ক্ষেপে যায় সৌদি আরব। তাই প্রধানত এই দেশ দুটির ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি ও রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে এবং মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে, ল্যাটিন আমেরিকায় ভেনিজুয়েলার প্রভাব ক্ষুণ্ন করে মার্কিন প্রভাব বাড়াতে সৌদি আরব স্বল্প মূল্যে তেলের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে বিশ্ব বাজারে! সৌদি আরবেরও এতে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে কিন্তু বিশ্ব তেল বাজারে সৌদি আরবের ভূমিকা বিশ্বব্যাংক অথবা ঠিক কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো। সৌদি আরবের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হলেও রিজার্ভ ডলার দিয়ে সৌদি আরব আপাতত তা সামলে নেবে কিন্তু নিজের ক্ষতি করে হলেও 'শত্রুদের' শায়েস্তা করতে চায় সৌদি আরব আর এক্ষেত্রে তার প্রধান ও একমাত্র অস্ত্র তেল! এছাড়া তার সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই। সৌদি আরবের ভুমিকা ঠিক এরকমই- গল্পে এক ব্যক্তি নিজের একটি চোখ অন্ধ করে হলেও সে তার প্রতিবেশীর দুটি চোখ অন্ধ করতে চায়!
ওপেক সৌদি আরবকে তেল উত্তোলন কমানোর বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তা আমলে নিচ্ছে না রিয়াদ সরকার। তবে, সৌদি আরবের এই তেল অস্ত্র বেশিদিন কার্যকারী হবে না। এর প্রধানত কারণ তিনটি-
১. তেলের দাম ৫০ ডলারের নিচে নেমে আসলেও ইরান ও রাশিয়ার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে এমনটি হওয়ার নয় বা তারা সৌদির কাছে স্যারেন্ডার করবে এমনটি হওয়ারও সম্ভাবনা নেই অর্থাৎ সৌদি যা আশা করছে তা হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।
২. সৌদি আরবের এতে নিজেরও বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি সৌদি কতদিন বা কত মাস সামাল দিতে পারবে তা দেখার বিষয়। কারণ সৌদির অর্থনীতি শতভাগ তেলনির্ভর কিন্তু ইরান ও রাশিয়ার অর্থনীতি সৌদির মতো তেল নির্ভর নয়।
৩. অন্যান্য তেল উৎপাদক দেশগুলোও বিপুল পরিমাণ ক্ষতির শিকার হচ্ছে। তারা কতদিন মার্কিন ও সৌদি চাপ মুখ বুঝে সহ্য করে তা অবশ্যই পর্যবেক্ষণের বিষয়। আগামী কিছুদিনের মধ্যে ওপেক বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। নিশ্চয় সৌদি আরব তার পাশে অন্য কোনো তেল উৎপাদক দেশ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই তবে এটাও সত্যি সৌদিকে বাদ দিয়ে ওপেক তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নয়।
যাইহোক, সৌদি আরবের এ ভূমিকায় তেল উৎপাদক দেশগুলো বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হলেও তেল আমদানিকারক দেশগুলোর সরকার আছে ফুরফুরে মেজাজে! তবে তেলের দাম এত কমার পরেও আমাদের মত তেল আমদানিকারক দেশগুলোর জনগণের জীবনযাত্রার মান যে বেড়েছে এমনটি নয়। লাভ হল শাসক গোষ্ঠীর, লাভ হল পুঁজিবাদী ও বেনিয়াদের, লাভ হল আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতির। পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতিকে আর একবার ধসের কিনারা থেকে থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসল সৌদি আরব, কিন্তু সৌদি আরব কি এর সুফল ঘরে তুলতে পারবে? মোটেই না। মাকিন ও পশ্চিমাদের সমর্থনে সৌদি রাজতন্ত্রের গদি রক্ষা করা ছাড়া সৌদি আরবের আলাদা কোনো সুফল নেই। তবে তেলের দাম আরো লাগামহীনভাবে ক্রমান্বয়ে কমতে থাকলে সৌদি রাজতন্ত্রের গদিও উল্টে যাবে। কারণ সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের ধুমায়িত চাপ প্রশমন করতে জনগণকে নিয়মিত ঘুষ দিতে রিয়াদকে ব্যয় করতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ।#
লেখক: মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
source : www.abna.ir