পবিত্র রমজান মাস আত্ম-সংশোধন ও আত্ম-উন্নয়নের সবচেয়ে উপযুক্ত মাস। তাই এ মাসে পাপ বর্জনের জন্য কুরআন ও হাদিস অধ্যয়নসহ ইসলামী জ্ঞান চর্চা জরুরি। আমরা অনেকেই ইবাদত-বন্দেগিকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে ইসলামী জ্ঞান-চর্চায় পিছিয়ে পড়ি। অথচ বিশ্বনবী (সা.)'র হাদিসের আলোকে নফল ইবাদত বন্দেগির চেয়ে জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব অনেক বেশি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, যে জানে আর যে জানে না, তারা কি সমান? ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানগত ভিত্তি ও স্তর যার যত উচ্চ হবে আল্লাহর কাছে তার ইবাদতও তত বেশি গ্রহণযোগ্য এবং পরিপূর্ণ হবে। পবিত্র রমজানের হুকুম-আহকাম বা মাসলা-মাসায়েল না জেনে রোজা রাখা ও সেগুলো জেনে রোজা রাখার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে। আরেকটা বিষয় মনে রাখা জরুরি, এমনভাবে আমাদের নফল ইবাদতে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না যা ফরজ ইবাদতগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা ফরজ ইবাদতগুলো পালনের মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি সৃষ্টি করে এবং ফরজ ইবাদতগুলোকে নিখুঁত ও একনিষ্ঠ করার সুযোগ নষ্ট করে দেয়।
খোদামুখী হওয়া তথা আত্ম-সংশোধন ও আত্ম-উন্নয়নের পথে এক বড় বাধা হল আমাদের আত্মপ্রীতি ও ভোগ-প্রবণতা এবং এসবের ফলে উদ্ভূত নানা রোগ। যেমন, অলসতা, আরাম-প্রিয় হওয়া এবং নিষিদ্ধ বিষয়ের মধ্যে আনন্দ অনুভব করা ইত্যাদি। সমাজে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নির্দেশ না থাকা এবং অপসংস্কৃতি ও ইসলামের শত্রুদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও মুসলিম সমাজগুলোর মধ্যে অবক্ষয় ও অধঃপতন ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। ইসলামের শত্রুরা ইসলামী বিষয়গুলো, ইসলামী সংস্কৃতি ও জিহাদ সম্পর্কে নানা ধরণের ঘৃণা আর ভয় সৃষ্টির চেষ্টা করছে যাতে তরুণ ও যুব সমাজ ইসলাম, ইসলামী সংস্কৃতি ও ইসলামী মূল্যবোধগুলোর দিকে আকৃষ্ট না হয়। অথচ তরুণ ও যুব সমাজ অপেক্ষাকৃত বেশি সত্য-সন্ধানী ও পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী হয় বলে ইসলামের দিকে তাদের এগিয়ে যাওয়ার এবং ইসলামের জন্য তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। আর এ জন্যই অপেক্ষাকৃত কম বয়সে আত্ম-সংশোধন ও আত্ম-উন্নয়নের প্রচেষ্টা শুরু করা উচিত যাতে এই প্রক্রিয়াকে জীবনে বেশি ফলপ্রসূ করা যায়। বলা হয়- যে নিজ আত্মাকে পবিত্র ও সংশোধন করতে পারেনি সে যতই বয়স্ক হতে থাকে তার মধ্যে পাপ-প্রবণতা ও লোভ ততই বাড়তে থাকে।
পার্থিব সম্পদ ও ক্ষমতাকে যারা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছে তাদের উপমা হল সেই নৌকার মত যার মধ্যে পানি ঢুকে পড়ায় তা ডুবে যায়। অন্যদিকে যারা এইসব বিষয়কে কেবল পার্থিব জীবনের বস্তুগত উপকরণ বলে মনে করেন তাদের উপমা হচ্ছে এমন নৌকার মত যা সব সময় পানির ওপর ভেসে থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়।
আমাদের ইমান বা খোদাভীতি কতটা জোরদার বা দুর্বল হচ্ছে তা নানা পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, যখন দেখবে যে কোনো অন্যায় বা পাপ কাজের পর তোমার মধ্যে অনুশোচনা জেগে উঠেছে তখন বুঝবে যে তোমার ইমান রয়েছে (দুর্বল পর্যায়ের হলেও)। আমরা যদি সত্যকে জানার জন্য ও আত্ম-উন্নয়নের জন্য পবিত্র কুরআন এবং মহানবী (সা.)'র জীবনী ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের বর্ণনাগুলোর প্রতি আগ্রহী না হই তাহলে বুঝতে হবে যে আমাদের ইমান দুর্বল বা অন্তরের চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। আর এ জন্যই আধ্যাত্মিক আলোর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে না। কেউ যখন অন্ধ হয়ে যায় তখন আলো তার কোনা উপকারেও আসে না।
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নির্দেশের ক্ষেত্রেও মানুষের ইমানের অবস্থা পরীক্ষা করা যায়। যেমন, জালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বা প্রতিরোধ হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইমানের প্রকাশ। মৌখিক প্রতিবাদ হচ্ছে এক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বল ইমানের লক্ষণ। আর অন্তরের দিক থেকে ঘৃণা হচ্ছে এক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্বল ইমানের নিদর্শন। কিন্তু কেউ যদি জুলুম ও অন্যায়কে সমর্থন দেয় নীরবে বা প্রকাশ্যে তাহলে সে হয়ে পড়ে জুলুমের শরিক এবং এ ধরনের মানুষের হৃদয় ইমানহীন। ইমানকে পরীক্ষা করে দেখার এমন অনেক উপায় আছে। গাজায় ও লেবাননে যখন ইসরাইল হত্যাযজ্ঞ চালায় তখন কারো কারো নীরবতা, কারো কারো প্রতিরোধ যুদ্ধ বা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রতি সহায়তা ও কারো কারো অন্তত মৌখিক নিন্দা ইমানের অবস্থাকে তুলে ধরে। ইয়েমেনে গত কয়েক মাসে একটি আরব দেশের নির্বিচার হামলায় কয়েক হাজার নিষ্পাপ শিশু নিহত হয়েছে! নিহত বেসামরিক নারী ও পুরুষের সংখ্যাও আরও কয়েক হাজার!- কোনো মুসলমানের বিবেক কি এ ধরনের হামলাকে সমর্থন করতে পারে?
অনেক সরল-মনা মুসলমান ইরাক ও সিরিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলের ওপর পশ্চিমা মদদপুষ্ট তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসীদের বিজয়কে বিস্ময়কর সাফল্য বলে মনে করছেন! যদি তাই ঠিক হয় তাহলে তো চেঙ্গিস খান ও হালাগু খানদের নৃশংসতা, গণহত্যা এবং দিগ-বিজয়কেও তাদের উচিত প্রশংসা করা!
যখনই আমরা অনুভব করব যে আমাদের আত্মা মলিন হয়ে আসছে বা ইমান দুর্বল হয়ে পড়ছে, কিংবা নিজের মধ্যে জোরদার হচ্ছে পাশবিক প্রবণতা তখনই আমাদের উচিত তওবা করে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া এবং অভিশপ্ত শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষার জন্য খোদায়ী দিক-নির্দেশনার প্রার্থনা করা।
এবারে পড়া যাক অর্থসহ ১১ তম রোজার দোয়া:
اليوم الحادي عشر : اَللّـهُمَّ حَبِّبْ اِلَيَّ فيهِ الاِْحْسانَ، وَكَرِّهْ اِلَيَّ فيهِ الْفُسُوقَ وَالْعِصْيانَ، وَحَرِّمْ عَلَيَّ فيهِ السَّخَطَ وَالنّيرانَ بِعَوْنِكَ يا غِياثَ الْمُسْتَغيثينَ .
হে আল্লাহ ! এ দিনে সৎ কাজকে আমার কাছে প্রিয় করে দাও আর অন্যায় ও নাফরমানীকে অপছন্দনীয় কর । তোমার অনুগ্রহের উসিলায় আমার জন্য তোমার ক্রোধ ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হারাম করে দাও । হে আবেদনকারীদের আবেদন শ্রবণকারী । #
source : irib.ir