শিয়া আলেমদের দৃষ্টিতে খিলাফত একটি ইলাহী পদ যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে যোগ্য ও সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে প্রদান করা হয়। ‘ইমাম’ ও ‘নবী’র মধ্যকার স্পষ্ট পার্থক্যকারী সীমা-পরিসীমা হচ্ছে ‘নবী’ শরীয়তের প্রতিষ্ঠাতা, ওহীর অবতরণস্থল এবং ইলাহী গ্রন্থের ধারক বা আনয়নকারী। ‘ইমাম’ যদিও এ পদমর্যাদাসমূহের একটিরও অধিকারী নন, তবে হুকুমত (প্রশাসন), তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করার পদাধিকারী হওয়া ছাড়াও তিনি (ইমাম) ধর্মের ঐ অংশের ব্যাখ্যাকারী, যা সুযোগ-সুবিধার অভাবে এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ার কারণে ‘নবী’ ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করতে সক্ষম হন নি এবং তা বর্ণনা করার দায়িত্ব তাঁর উত্তরাধিকারীদের (ওয়াসী) ওপর অর্পণ করেছেন।
অতএব, শিয়া মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে খলীফা কেবল যুগের শাসনকর্তা এবং ইসলাম ধর্মের সার্বিক বিষয়ের কর্তৃত্বশীল, (শরীয়তের) বিধি-বিধান বাস্তবায়নকারী, অধিকারসমূহ সংরক্ষণকারী এবং ইসলামী রাষ্ট্রের অখণ্ডত্ব, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার রক্ষকই নন; বরং তিনি ধর্ম ও শরীয়তের জটিল ও দুরূহ বিষয়াদির স্পষ্ট ব্যাখ্যাকারী এবং বিধি-বিধানসমূহের ঐ অংশের পূর্ণতাদানকারী, যা বিভিন্ন কারণে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বর্ণনা ও ব্যাখ্যা প্রদান করেন নি।
তবে আহলে সুন্নাতের আলেমদের দৃষ্টিতে ‘খিলাফত’ একটি গৌণ ও সাধারণ (লৌকিক) পদ এবং এ পদ সৃষ্টির লক্ষ্য মুসলমানদের বাহ্য অস্তিত্ব ও অবস্থা এবং তাদের জাগতিক বিষয়াদির সংরক্ষণ ব্যতীত আর কিছুই নয়। যুগের খলীফা সর্বসাধারণের (মুসলিম জনতার) রায় ও অভিমতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বিচারকাজ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হন। আর অন্যান্য বিষয় এবং শরীয়তের ঐসব বিধান, যেসব রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর যুগে সংক্ষিপ্তসারে প্রণয়ন করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তাঁর যুগে বিভিন্ন কারণবশত তা ব্যাখ্যা করতে পারেন নি, সেই সব বিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মুসলিম আলেমদের সাথে সংশ্লিষ্ট, যাঁরা এ ধরনের সমস্যা ও জটিল বিষয় ইজতিহাদ প্রক্রিয়ায় সমাধান করেন।
এ ধরনের অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে খিলাফতের স্বরূপকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে দু’টি ধারার উদ্ভব হয়েছে এবং মুসলিম উম্মাহ্ এ কারণে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। আর আজও এ মতভিন্নতা বিদ্যমান।
প্রথম দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ‘ইমাম’ কতিপয় দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে ‘নবী’র সাথে শরীক এবং একই রকম। আর যে সব শর্ত ও অবস্থা নবীর জন্য অপরিহার্য, সেসব ইমামের ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। এ সব শর্ত নিম্নরূপ :
১. নবী অবশ্যই মাসূম (নিষ্পাপ) হবেন অর্থাৎ তিনি তাঁর জীবনে কখনো পাপ করবেন না এবং শরীয়তের বিধি-বিধান এবং ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ ও বাস্তব তাৎপর্য ব্যাখ্যা এবং জনগণের ধর্ম সংক্রান্ত প্রশ্নাবলীর জবাব দানের ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি ও স্খলনের শিকার হবেন না। আর ইমামও অবশ্যই এমনই হবেন এবং উভয় পক্ষের (অর্থাৎ নবী ও ইমামের নিষ্পাপ হবার) দলিল-প্রমাণ এক ও অভিন্ন।
২. নবী অবশ্যই শরীয়ত সম্পর্কে সবচেয়ে জ্ঞানী হবেন এবং ধর্মের কোন বিষয়ই তাঁর কাছে গোপন থাকবে না। আর ইমামও যেহেতু শরীয়তের ঐ অংশের পূর্ণতাদানকারী ও ব্যাখ্যাকারী- যা নবীর ইহজীবনকালে বর্ণনা করা হয়নি, সেহেতু তিনি অবশ্যই ধর্মের যাবতীয় বিধান ও বিষয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জ্ঞানী হবেন।
৩. নবুওয়াত নির্বাচনভিত্তিক পদ নয়; বরং তা হচ্ছে নিয়োগ বা মনোনয়নভিত্তিক। আর মহান আল্লাহ্ নবীকে অবশ্যই (জনগণের কাছে) পরিচিত করান এবং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি নবুওয়াতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। কারণ একমাত্র মহান আল্লাহ্ই নিষ্পাপ ব্যক্তিকে অনিষ্পাপ ব্যক্তিদের থেকে পৃথক করতে সক্ষম এবং কেবল তিনিই ঐ ব্যক্তিকে চেনেন যিনি খোদায়ী গায়েবী অনুগ্রহ এবং তত্ত্বাবধানে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন, যিনি দীন ও শরীয়তের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত।
এ তিন শর্ত যেমনভাবে নবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (অপরিহার্য), ঠিক তেমনি ইমাম ও নবীর স্থলবর্তীর ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
তবে দ্বিতীয় অভিমতের ভিত্তিতে নবুওয়াতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শর্তাবলীর একটিও ইমামের ক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়। তাই না নিষ্পাপত্ব (ইসমাত), না ন্যায়পরায়ণতা (আদালত), আর না জ্ঞান (ইলম) অপরিহার্য, আর না শরীয়তের ওপর পূর্ণ দখল, না খোদায়ী নিয়োগ ও মনোনয়ন (অপরিহার্য) শর্ত বলে বিবেচিত, আর না গায়েবী জগতের সাথে সম্পর্ক এ ক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য। বরং এতটুকুই যথেষ্ট যে, তিনি (ইমাম বা খলীফা) নিজের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার দ্বারা এবং মুসলমানদের সাথে পরামর্শ করে ইসলাম ধর্মের সম্মান, মর্যাদা এবং বাহ্য অস্তিত্ব রক্ষা করবেন, শরীয়তের দণ্ডবিধি প্রয়োগ করে ইসলামী রাষ্ট্র ও দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করবেন এবং মুসলমানদের জিহাদ করার প্রতি আহবান জানানোর মাধ্যমে ইসলামের রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত করার প্রয়াস চালাবেন। আসলে ইমামত কি একটি মনোনয়নভিত্তিক পদ, নাকি নির্বাচনভিত্তিক পদ? এটা কি অপরিহার্য ছিল যে, মহানবী (সা.) নিজেই তাঁর উত্তরাধিকারী ও স্থলবর্তী (খলীফা) মনোনীত করবেন বা খলীফা মনোনীত করার দায়িত্ব উম্মতের ওপর ছেড়ে দেবেন? আমরা এখন বেশ কতকগুলো সামাজিক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে এসব প্রশ্নের সমাধান করার চেষ্টা করব এবং আপনারা স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারবেন, সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে অবধারিত হয়ে গিয়েছিল যে, স্বয়ং মহানবী (সা.) তাঁর ইহজীবনকালে স্থলবর্তী ও উত্তরাধিকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করবেন এবং তা উম্মাহর নির্বাচন ও মনোনয়নের ওপর ছেড়ে দেবেন না। এখন আমরা এ সংক্রান্ত আরো স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করব।
খলীফা ও উত্তরাধিকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যায়ন
এতে কোন সন্দেহ নেই, ইসলাম বিশ্বজনীন ও সর্বশেষ (এবং চিরকালীন প্রেক্ষিত সহ চূড়ান্ত) দীন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত মহানবী (সা.) জীবিত ছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণকে নেতৃত্বদান ও পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত। আর তাঁর ওফাতের পর নেতৃত্বের পদ অবশ্যই মুসলিম উম্মাহর যোগ্যতম ব্যক্তিদের কাছে অর্পিত হবে।
মহানবী (সা.)-এর পর নেতৃত্বের পদ কি মনোনয়নভিত্তিক, না তা নির্বাচনভিত্তিক পদ- এ ব্যাপারে দু’ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত প্রচলিত আছে। শিয়ারা বিশ্বাস করে, নেতৃত্বের পদ আসলে মনোনয়নভিত্তিক এবং মহানবী (সা.)-এর স্থলবর্তীকে অবশ্যই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত হতে হবে। অথচ আহলে সুন্নাত বিশ্বাস করে, এ পদ নির্বাচনভিত্তিক এবং অবশ্যই মহানবীর পর উম্মাহ্ এক ব্যক্তিকে ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বিক বিষয় পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করবে। উভয় মাযহাবই নিজ নিজ অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গির সপক্ষে দলিলসমূহ পেশ করেছে, যেসব আকীদা-বিশ্বাস বিষয়ক গ্রন্থাবলীতে বিদ্যমান। তবে এখানে যা উত্থাপন করা যেতে পারে, তা হলো মহানবী (সা.)-এর যুগে প্রভাব বিস্তারকারী পরিবেশ-পরিস্থিতির (সঠিক) ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, যা এ দৃষ্টিভঙ্গিদ্বয়ের যে কোন একটিকে প্রমাণ করবে।
মহানবী (সা.)-এর যুগে ইসলামের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টি অবধারিত হয়ে যায় যে, মহান আল্লাহ্ মহানবী (সা.)-এর খলীফা কেবল মহানবীর মাধ্যমেই নিযুক্ত করবেন। কারণ তখনকার ইসলামী সমাজ এক ত্রিভুজীয় অক্ষশক্তির (রোম, পারস্য ও মুনাফিক চক্রের সমন্বয়ে গঠিত) পক্ষ থেকে সর্বদা যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, অশান্তি এবং অনৈক্যের মতো হুমকির সম্মুখীন ছিল। আর একইভাবে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এটি অত্যাবশ্যক হয়ে যায় যে, মহানবী (সা.) রাজনৈতিক নেতা মনোনয়নের মাধ্যমে সমগ্র উম্মাহকে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড় করাবেন এবং শত্রুর আধিপত্য খর্ব করবেন। কারণ উম্মাহর অভ্যন্তরীণ অনৈক্য তাদের মাঝে শত্রুর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এ ত্রিভুজীয় অক্ষশক্তির একটি বাহু ছিল রোমান সাম্রাজ্য। এ পরাশক্তি তখন আরব উপদ্বীপের উত্তরে অবস্থান করছিল এবং তা সবসময় মহানবীর চিন্তা-ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এমনকি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত রোমীয়দের চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারছিলেন না। রোমের খ্রিষ্টীয় সেনাবাহিনীর সাথে মুসলমানদের প্রথম সামরিক সংঘাত হিজরতের অষ্টম বর্ষে ফিলিস্তিনে সংঘটিত হয়েছিল। এ সংঘর্ষে জাফর তাইয়্যার, যাইদ ইবনে হারিসাহ্ এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা নামের তিন সেনাপতি শাহাদাত বরণ করেন এবং মুসলিম সেনাবাহিনী পরাজিত হয়।
কুফরী সেনাশক্তির সামনে মুসলিম বাহিনীর পশ্চাদপসরণ কাইসার অর্থাৎ রোমান সম্রাটের সেনাবাহিনীর স্পর্ধার কারণ হয়েছিল এবং যে কোন সময় ইসলামের প্রাণকেন্দ্র (পবিত্র মদীনা নগরী) আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বিরাজ করছিল। এ কারণেই মহানবী (সা.) হিজরতের নবম বর্ষে এক বিশাল ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল সেনাবাহিনী নিয়ে শামের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর দিকে যাত্রা করেন, যাতে তিনি নিজেই সেখানে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পারেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কষ্টে পরিপূর্ণ এ অভিযানের মাধ্যমে ইসলামী বাহিনী তাদের পুরনো মর্যাদা ফিরে পেয়েছিল এবং নিজেদের রাজনৈতিক জীবনের নবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল।
এ আংশিক বিজয় মহানবী (সা.)-কে সন্তুষ্ট করতে পারে নি এবং তাঁর অসুস্থ হবার কয়েক দিন আগেও তিনি উসামা ইবনে যায়েদের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনীকে শাম সীমান্তে গমন করে রণাঙ্গনে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
প্রাগুক্ত ত্রিভুজীয় শত্রুশক্তির দ্বিতীয় বাহু ছিল পারস্য সাম্রাজ্য (ইরান)। কারণ পারস্য-সম্রাট খসরু প্রচণ্ড আক্রোশ সহকারে মহানবী (সা.)-এর প্রেরিত পত্র ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছিল এবং মহানবীর দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। সে মহানবী (সা.)-কে বন্দী বা প্রতিরোধ করলে হত্যার নির্দেশ দিয়ে ইয়েমেনের গভর্নরের কাছে চিঠি লিখেছিল।
খসরু পারভেয মহানবীর ইহজীবনকালে মৃত্যুবরণ করে। তবে ইয়েমেন অঞ্চল, যা দীর্ঘকাল পারস্য সাম্রাজ্যের উপনিবেশ ছিল, সেই ইয়েমেনের স্বাধীনতার বিষয়টি পারস্যের সম্রাটদের চিন্তা-ভাবনার বাইরে ছিল না। আর তীব্র অহংকারের কারণে পারস্য সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও শাসকশ্রেণী (আরব উপদ্বীপে) এ ধরনের শক্তির (মহানবীর নেতৃত্বে) অস্তিত্ব মোটেই মেনে নিতে পারছিল না।
তৃতীয় বিপদ ছিল মুনাফিকচক্রের পক্ষ থেকে, যারা সর্বদা ‘পঞ্চম বাহিনী’ হিসেবে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার অপকর্ম ও (অশুভ) তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। এমনকি তারা মহানবীর প্রাণনাশেরও চেষ্টা করেছিল অর্থাৎ তারা তাঁকে তাবুক ও মদীনার সড়কে হত্যা করতে চেয়েছিল। মুনাফিকদের মধ্যকার একটি দল নিজেদের মধ্যে গোপনে বলাবলি করত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মৃত্যুর সাথে সাথে ইসলামী আন্দোলনেরও পরিসমাপ্তি হবে; আর তখন সবাই প্রশান্তিলাভ করবে।
মহানবী (সা.) এর ওফাতের পর আবু সুফিয়ান এক অশুভ পাঁয়তারা করেছিল এবং হযরত আলীর হাতে বাইয়াত করার মাধ্যমে মুসলমানদের দু’দলে বিভক্ত করে পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত করাতে চেয়েছিল যাতে সে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আলী (আ.) তাঁর বিচক্ষণতার কারণে আবু সুফিয়ানের নোংরা অভিপ্রায়ের কথা জেনে যান বলেই তিনি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন :
“মহান আল্লাহর শপথ! ফিতনা ছাড়া তোমার আর কোন উদ্দেশ্য নেই। কেবল আজকেই (প্রথম বারের মতো) তুমি ফিতনার অগ্নি প্রজ্বলিত করতে চাচ্ছ না; বরং তুমি (এর আগেও) বারবার অনিষ্ট সাধন করতে চেয়েছ। তুমি জেনে রাখ, তোমার প্রতি আমার কোন প্রয়োজন নেই।”
মুনাফিকদের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা এতটাই ছিল যে, পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরান, সূরা নিসা, সূরা মায়েদাহ্, সূরা আনফাল, সূরা তাওবা, সূরা আনকাবুত, সূরা আহযাব, সূরা হাদীদ, সূরা মুনাফিকীন এবং সূরা হাশরে তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে।
গোপনে ওঁৎ পেতে থাকা এসব ক্ষমতাবান শত্রুর উপস্থিতি সত্বেও এটা কি সঠিক হবে যে, মহানবী (সা.) নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজের ধর্মীয়-রাজনৈতিক নেতৃত্বে তাঁর কোন স্থলবর্তী নিযুক্ত করবেন না? সামাজিক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনাসমূহ ব্যক্ত করে যে, মহানবী (সা.) অবশ্যই নেতা, প্রধান ও দায়িত্বশীল নিযুক্ত করে তাঁর (ওফাতের) পর সব ধরনের মতবিরোধের পথ রুদ্ধ এবং একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে ইসলামী ঐক্যের নিশ্চয়তা বিধান করে যাবেন।
কেবল নেতা নিযুক্ত করা ছাড়া ভবিষ্যতে যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকানো এবং ‘নেতা অবশ্যই আমাদের মধ্য থেকে হবে’- মহানবীর ওফাতের পর কোন গোষ্ঠীকে এ ধরনের কথা থেকে বিরত রাখা মোটেই সম্ভব ছিল না।
এ সব সামাজিক মূল্যায়ন আমাদেরকে মহানবীর পরে নেতৃত্ব যে মনোয়নভিত্তিক- এ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমতের সঠিক হওয়ার দিকেই পরিচালিত করে। সম্ভবত এ কারণ এবং অন্যান্য কারণেও মহানবী (সা.) বে’সাতের (নবুওয়াতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়া) প্রথম দিনগুলো থেকে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত তাঁর স্থলবর্তী নিযুক্ত করার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর রিসালতের শুরুতে এবং শেষে তাঁর উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করে গেছেন।
নবুওয়াত ও ইমামত পরস্পর সংযুক্ত
খিলাফত সংক্রান্ত প্রথম দৃষ্টিভঙ্গির সত্যতা নিশ্চিতভাবে প্রমাণকারী সামাজিক মূল্যায়নসমূহের অনুকূলে বিদ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক দলিল-প্রমাণ ছাড়াও মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহও শিয়া আলেমগণের দৃষ্টিভঙ্গির সত্যায়ন করে। মহানবী (সা.) তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালনকালে তাঁর উত্তরসূরি নিযুক্ত করার কথা বারবার ঘোষণা করেছেন এবং এভাবে তিনি ইমামত অর্থাৎ নেতৃত্বকে নির্বাচন তথা সর্বসাধারণের রায় ও অভিমতের মুখাপেক্ষী হওয়ার গণ্ডি থেকে বের করে এনেছেন।
মহানবী (সা.) কেবল তাঁর জীবনের শেষভাগে তাঁর উত্তরসূরি নিযুক্ত করেন নি; বরং রিসালাতের সূচনায় যখন মাত্র কয়েক শ’ লোক ছাড়া আপামর জনতা তাঁর প্রতি ঈমান আনে নি, সে মুহূর্তেও তিনি জনগণের সামনে তাঁর ওয়াসী (নির্বাহী ও ওসিয়ত বাস্তবায়নকারী) ও উত্তরসূরিকে পরিচিত করিয়েছিলেন।
একদিন মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নিকটাত্মীয়দের (বনী হাশিম) মহান আল্লাহর আযাব থেকে সতর্ক করা এবং সাধারণ মানুষের প্রতি আহবান জানানোর পূর্বে তাদের তাওহীদী ধর্মের দিকে আহবান জানানোর জন্য আদিষ্ট হলেন। তিনি বনী হাশিমের ৪৫ জন নেতার উপস্থিতিতে আয়োজিত সভায় বলেছিলেন : “আপনাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আমাকে সাহায্য করবে, সে আপনাদের মাঝে আমার ভাই, ওয়াসী এবং স্থলবর্তী হবে।” হযরত আলী (আ.) তাঁদের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর রিসালাতের স্বীকৃতি দিলে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিলেন : “এ যুবকই আমার ভাই, ওয়াসী এবং স্থলবর্তী (খলীফা)।”
এ হাদীসই মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণের কাছে ‘হাদীসু ইয়াওমিদ দার’ (বাড়িতে আয়োজনকৃত সমাবেশ-দিবসের হাদীস) বা ‘হাদীসু বিদ ইদ দাওয়াহ্’ (প্রচার কার্যক্রম শুরুর হাদীস) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
মহানবী (সা.) শুধু রিসালাতের সূচনায়ই নয়; বরং বিভিন্ন উপলক্ষে- কি সফরে, কি নিজ এলাকায় অবস্থান কালে হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়েত (নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব) এবং স্থলবর্তী ও খলীফা হবার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। তবে এসবের মধ্যে কোনটিই মর্যাদা, তাৎপর্য, স্পষ্টতা, অকাট্যতা এবং সর্বজনীনতার দিক থেকে ‘হাদীসে গাদীরে খুম’-এর (গাদীরে খুমের হাদীস) সমপর্যায়ের নয়।
[সূত্র: আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানির লেখা ‘চিরভাস্বর মহানবী-(সা)’, দ্বিতীয় খণ্ড]
source : alhassanain