বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

ইরফান ও তাসাউফ

ইরফান ও তাসাউফ-বহুল প্রচলিত পরিভাষায় সুফীবাদ,দীনদারী,মুক্তিসন্ধান,খোদাপ্রেম ও মুক্তির সমন্বিত অর্থে তা ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার অনুপ্রেরণা থেকে উৎসারিত। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসী,হযরত আবু যার গিফারী,হযরত শুহাইব ইবনে সিনান ও হযরত আম্মার দীনদারী ও ইখলাছের জন্য সুপরিচিত এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁরা ছিলেন ‘আসহাবে সুফ্ফার’১ অন্যতম। কোন কোন গ্রন্থে হযরত সালমান ফারসী,হযরত উয়াইস কারানী ও হযরত হাসান বাসরীকে সুফী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদে
ইরফান ও তাসাউফ

ইরফান ও তাসাউফ-বহুল প্রচলিত পরিভাষায় সুফীবাদ,দীনদারী,মুক্তিসন্ধান,খোদাপ্রেম ও মুক্তির সমন্বিত অর্থে তা ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার অনুপ্রেরণা থেকে উৎসারিত। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসী,হযরত আবু যার গিফারী,হযরত শুহাইব ইবনে সিনান ও হযরত আম্মার দীনদারী ও ইখলাছের জন্য সুপরিচিত এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁরা ছিলেন ‘আসহাবে সুফ্ফার’১ অন্যতম। কোন কোন গ্রন্থে হযরত সালমান ফারসী,হযরত উয়াইস কারানী ও হযরত হাসান বাসরীকে সুফী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের প্রতি অনেকে আধ্যাত্মিক পূর্ণতা (কামালিয়াত) ও বিভিন্ন ধরনের গুণাবলী আরোপ করে থাকেন।

উমাইয়্যা শাসনামলে স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক ও দুনিয়াপূজারী শাসকরা ইসলামের সঠিক শিক্ষাকে নির্বাসিত করে। এ সময় বিরাজমান পরিস্থিতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে একদল খাঁটি মুসলমান নিজেদেরকে পার্থিব বিষয়াদি থেকে দূরে সরিয়ে নেন এবং ধর্ম-কর্ম ও ইবাদত বন্দেগীতে আত্মনিয়োগ করেন। ইবনে খালদুনের মতে,পরবর্তীকালে এ গোষ্ঠী ‘সুফীয়াহ্’ (صوفیة) নামে পরিচিত হন।

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন যে,অনারব জনগণের ওপর (যাদের বেশিরভাগই ছিল ইরানী) আরবদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ‘শুয়ূবিয়্যাহ্ আন্দোলন’২ থেকেই সুফীবাদের জন্ম হয়।

কেউ কেউ বলেন,‘সুফী’ শব্দটির মূল হচ্ছে ‘সুফ্’ যার মানে ‘পশম’;সুফীরা আত্মিক পূর্ণতায় উপনীত হবার লক্ষ্যে নিজেদেরকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে মোটা পশমের তৈরি পোশাক পরিধান করতেন বলে তাঁদেরকে ‘সুফী’ বলা হতো।

সর্বপ্রথম যে গ্রন্থে ‘সুফীয়্যাহ্’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে আল-জাহেয৩ লিখিত ‘আল বায়ান্ ওয়াত্ তিবয়ীন’। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির জন্য ‘সুফী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় তিনি হলেন আবু হাশেম সুফী৪;তিনি ছিলেন সুফিয়ান সাওরী (মৃত্যু ১৬১ হি.) ও ইবরাহীম আদহাম বালখী (মৃত্যু ১৬২ হি.)-এর সমসাময়িক।

সুফীবাদের উৎপত্তি

আত্মসংশোধন,আত্মসংযম,আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সত্যের উদ্ঘাটন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভরশীলতা এ ক’টি ধারণার ওপর সুফীবাদ প্রতিষ্ঠিত। এ সবের মাধ্যমে সাধকের হৃদয় সকল প্রকার পঙ্কিলতা থেকে পরিশুদ্ধ হয় এবং তাজাল্লীর মাধ্যমে হৃদয়ে আল্লাহর নূরের প্রতিফলন ঘটে। এর ফলে অব্যবহিত যে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তা হচ্ছে সাধকের কাছে অদৃশ্য দৃশ্যমান হয় এবং সকল পর্দা অপসারিত হয়।

প্রকৃতপক্ষে মানব জাতির ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই সকল ধর্মেই এ ধরনের প্রচেষ্টা ও আধ্যাত্মিক সাধনা লক্ষ্য করা গেছে। তাই কোন বিশেষ যুগে,দেশে ও জাতি বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ আধ্যাত্মিক সাধনা আন্দোলনের ঐতিহাসিক উৎপত্তি অনুসন্ধান করা সম্ভব নয়। তাই কবির এ কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য :

“এমন কোন মস্তিষ্ক নেই যাতে খোদার রহস্য নিহিত নেই।”

সূচনায় সুফীবাদ ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল একটি আধ্যাত্মিক আবেদন হিসাবে। যাঁরা ধর্মীয় জীবনযাপন করতেন,জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন এবং আল্লাহ্ তায়ালার জন্য পুরোপুরি উৎসর্গীকৃত ছিলেন তাঁদেরকেই সুফী বলা হতো। তবে কালের প্রবাহে সুফীবাদের সরলতা হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরনের বিজাতীয় মতাদর্শের সাথে সংমিশ্রণের ফলে,যেমন নিউ প্লেটোনিজম (ঈশ্বর থেকে সৃষ্টির নিষ্পন্ন হওয়ার তত্ত্ব),প্রাচীন খ্রিষ্টীয় মরমীবাদ,পিথাগোরীয়ানবাদ,স্টোয়িসিজম (জেনোর মতবাদ;সুখ-দুঃখের প্রতি ঔদাসীন্য),ইরানের খোসরাভী দর্শন (পাহলাভিয়্যাত)৫,হিন্দু ধর্ম (বেদান্ত দর্শন),বৌদ্ধ ধর্ম,খ্রিষ্টধর্ম এবং তৎকালে প্রচলিত মানীচীয়ান,মাযদী ও মাজিয়ান ধর্মের অনুরূপ মরমী প্রবণতার সংস্পর্শে আসায় সুফীবাদের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। এর ফলে রহস্যে আবৃত প্রকৃত সত্য ও অবস্থা উদ্ঘাটন (মুকাশাফাহ্),প্রত্যক্ষকরণ (মুশাহাদাহ্),প্রেম ও বিচ্ছেদ ইত্যাদি ধ্যান-ধারণা ভিত্তিক একটি মিশ্র দর্শনের উদ্ভব ঘটে। এ দর্শনের ঝোঁক ও প্রবণতার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ্ তায়ালার নিরঙ্কুশ একত্ব (তাওহীদে মুতলাক),সত্তা বা অস্তিত্বের একত্ব (ওয়াহ্দাতুল উজুদ),আল্লাহতে আত্মার বিলুপ্তি (ফানাফিল্লাহ্) এবং ঐশী সত্তায় একীভূত হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহতে চিরন্তনত্ব লাভ (বাকাবিল্লাহ্)। অতএব,সুফীবাদ কোন সুনিদিষ্ট ধর্ম নয় বা অন্যান্য চিন্তাধারা থেকে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনাযোগ্য কোন চিন্তাধারা বা চৈন্তিক পদ্ধতি নয়। তবে একটি কথা সুস্পষ্টভাবে বলা যেতে পারে যে,সুফীবাদের দাবি অনুযায়ী সুফীবাদের ভিত্তি হচ্ছে খাঁটি তাওহীদ (একত্ববাদ) এবং এ মতবাদ অনুযায়ী যে কারো পক্ষেই আল্লাহ্ তায়ালার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব। তাই বলা হয়েছে :

“আল্লাহ্ অভিমুখী পথের সংখ্যা সৃষ্টি সংখ্যার (মানুষ সংখ্যার) অনুরূপ।”

অন্য কথায় প্রতিটি হৃদয়ই আল্লাহ্ অভিমুখী একেকটি পথ খুলে দেয়। হিজরী তৃতীয় শতকে মুসলিম সমাজে মরমী শিক্ষা প্রবেশ করে। যদিও সুফী মূলত কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত,নবী করীম (সা.)-এর বিভিন্ন হাদীস ও সুন্নাহ্ এবং অন্যান্য ইসলামী ঐতিহ্যগত সূত্র থেকে উৎসারিত হয়েছে,তথাপি বলা যেতে পারে যে,এছাড়াও সেমিটিক৬ তাওহীদবাদ গ্রীক যুক্তিবাদের সাথে পিথাগোরিয়ান ও স্টোয়িক প্রভাব এবং কার্যকারণ তত্ত্ব,অ্যারিস্টটলীয় পরম কারণবাদ ও নিউ প্লেটোনিক সর্বেশ্বরবাদ সুফীবাদী আন্দোলনকে বিশেষ চরিত্র-বৈশিষ্ট্য প্রদানে ভূমিকা পালন করেছে।

আমাদের সালফে সালেহীন সত্যে উপনীত হবার জন্য চারটি পথের কথা ঘোষণা করেছেন। তা হচ্ছে :

১. হিকমাতে মাশশা (অ্যারিস্টটলীয় দর্শন)

২. হিকমাতে ইশরাক (সৃষ্টি হচ্ছে স্রষ্টার তাজাল্লী-এ দর্শন)

৩. ইলমে কালাম (পাণ্ডিত্যমূলক দর্শন) এবং

৪. ইরফান।

১. হিকমাতে মাশশা : হিকমাতে মাশশা বা অ্যারিস্টটলীয় দর্শন হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন। এ দর্শন কারণ ও প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। মুসলিম দার্শনিকগণের মধ্যে এ দর্শনের প্রধান প্রবক্তা ও ব্যাখ্যাকার হলেন আল কিন্দী,ফারাবী ও ইবনে সিনা।

২. হিকমাতে ইশরাক : হিকমাতে ইশরাক বা তাজাল্লী দর্শনের বক্তব্য হচ্ছে এই যে,নিরঙ্কুশ সত্য কেবল মুকাশাফাহ্,শওক (আকর্ষণ),ইশরাক (তাজাল্লী),ইশক (প্রেম) ও রিয়াযাহ্ (আত্মসংযম)-এর মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। এ দর্শন অনুযায়ী আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই ঈমান ও দীনের আলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে,নয়তো শুধু আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা মানুষকে পথ দেখাতে সক্ষম নয়। হিকমাতে মাশশার দার্শনিকদের ন্যায় হিকমাতে ইশরাকের দার্শনিকগণও শরীয়তের খুঁটি-নাটি বিধান অনুসরণকে অপরিহার্য গণ্য করেন না। কিন্তু তাঁরা শরীয়তের মৌলিক বিধানসমূহ অস্বীকার করেন না।

৩. ইলমে কালাম : এ দর্শন অনুযায়ী কেবল বিচারবুদ্ধির সাহায্যে তথা যুক্তিবিজ্ঞানসম্মত যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই সত্যে উপনীত হওয়া সম্ভব। এ ধারার দার্শনিকগণ খোদায়ী আহকামের যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা আহকাম বা বিচার-বুদ্ধির মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন এবং প্রতিপক্ষের আপত্তি খণ্ডন করেন। বিখ্যাত কালামশাস্ত্রবিদগণের মধ্যে ছিলেন ওয়াসেল বিন আতা,আল আশআরী,আল বাক্কেলানী,ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী,শাহরিস্তানী,আল্লামা হিল্লী ও খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী। তাঁদের সকলেই শারয়ী বিধি-বিধানের কঠোর অনুসারী ছিলেন।

৪. ইরফান বা মরমী দর্শন : ইরফানী দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে ইশরাক,ইনকিশাফ (রহস্য উন্মোচিত হওয়া এবং ইনজিযাব (আল্লাহতে বিলীন হওয়া)। আরেফগণ মনে করেন যে,আল্লাহকে পাওয়া এবং জানার জন্য বিচারবুদ্ধি ও যুক্তি যথেষ্ট নয়। তাঁরা ওহী তথা ঐশী গ্রন্থ,নবী-রাসূলগণের বাণী এবং শীর্ষস্থানীয় মুসলিম অলিদের অনুসরণ করেন। প্রকৃত আরেফগণ সর্বদা কোরআনের তেলাওয়াত ও আল্লাহর যিকিরে মশগুল থাকেন। তাঁরা সবসময়ই ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলেন।

শরীয়ত,তরীকত ও হাকীকত

শরীয়ত (ধর্মীয় বিধি-বিধান) : শরীয়ত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পানির উৎস অর্থাৎ যেখান থেকে পানি সংগ্রহ করা হয় তদভিমুখী পথ। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে শরীয়ত বলতে বুঝায় মানুষের ইহকালীন জীবনকে কল্যাণময়করণ ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে তাদের জন্য আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রদত্ত আদেশ-নিষেধসমূহ যা তিনি তাঁর রাসূলের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন এবং রাসূলের কথা ও কাজের মাধ্যমে তা মানুষকে জ্ঞাত ও বাস্তবায়িত করেছেন। যেহেতু শরীয়ত হচ্ছে আল্লাহর অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ যা সকল মানুষের জন্যই প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নবী-রাসূলগণকে পাঠিয়ে সমগ্র মানব জাতিকে উপকৃত ও অনুগ্রহ করেছেন।

‘শারহে গোলশানে রয’ গ্রন্থে প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী শরীয়ত হচ্ছে মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের বিধি-বিধান এবং তা বাইরের আবরণ বা খোলসের কাজ করে। আর কুশাইরী বলেন,‘শরীয়ত অপরিহার্যভাবেই ইসলাম (আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ)-এর সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ বা তাঁর দাসত্ব (ইবাদত) করা মানে আল্লাহর একত্বকে মেনে নেয়া,তাঁর নবী-রাসূলগণের নবুওয়াত বা রিসালাতের অনুকূলে সাক্ষ্যদান এবং ইসলামের অনুসরণ। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর উক্তি অনুযায়ী ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ যার মানে দাসত্বের দাবি অনুযায়ী কাজ করা।

বাহ্যিক ও গূঢ় দিক : ইসলামের বাহ্যিক ও গূঢ় উভয় দিকই রয়েছে। ইসলামের বাহ্যিক দিক হচ্ছে মৌখিক স্বীকারোক্তি বা বাহ্যত ইসলামের বিধি-বিধানের নিকট আত্মসমর্পণ। অন্যদিকে ইসলামের গূঢ় দিক মৌখিক স্বীকৃতির পাশাপাশি অন্তর থেকে আল্লাহ তায়ালার সাথে নিঃশর্ত সংশ্লিষ্টতা দাবি করে। বস্তুত এ হচ্ছে খাঁটি ঈমান। কারণ প্রকৃতপক্ষে মানুষের হৃদয় ও চেতনাই হচ্ছে আসল সত্তা।

শরীয়তের ভিত্তি হচ্ছে নিরঙ্কুশ সত্যের পরিচয় লাভ যা কেবল আত্মপরিচয়ের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই বলা হয়, من عرف نفسه فقد عرف ربّه (যে নিজেকে চিনেছে সে তার রবকে চিনেছে)। একটি হাদীসে কুদসী অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা বলেন,

كنت كترا مخفيا فاجببت أن أعرف فخلقت الخلق لكي أعرف

“আমি ছিলাম একটি গুপ্ত ধনভাণ্ডার,অতঃপর আমি নিজেকে পরিচিত করাতে চাইলাম,তাই আমি সৃষ্টিকে সৃষ্টি করলাম যাতে আমি পরিচিত হতে পারি।”

আল্লাহ তায়ালা স্বীয় অনুগ্রহবশত সৃষ্টিকর্মের প্রক্রিয়া শুরু করেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় স্বীয় গুণ-বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ প্রদানপূর্বক মানুষকে সৃষ্টি করেন। তিনি মানুষকে ধরণির বুকে তাঁর প্রতিনিধি মনোনীত করেন এবং তার ওপরে আল্লাহ্ তায়ালার পূর্ণ পরিচিতি অবগত হওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন। কবি হাফিয বলেন,

“যে আমানতের বোঝা আসমান বহন করতে পারে নি

তার ব্যাপারে ভাগ্য পরীক্ষার লটারীতে আমার মতো পাগলের নাম উঠল।”

আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম সৃষ্টির ইচ্ছা করেন। অতঃপর তিনি তাঁর ঐশী ইচ্ছা দ্বারা সবকিছুকে সৃষ্টি করেন। কেবল ইবাদতের মাধ্যমেই আল্লাহকে পাওয়া যেতে পারে এবং সর্বদা তাঁর স্মরণ অর্জিত হতে পারে। আল্লাহ তায়ালাকে সর্বদা স্মরণ রাখতে হলে সবসময় ইবাদতে অর্থাৎ নামায,রোযা,যাকাত,খুমস্,জিহাদ ইত্যাদিতে মশগুল থাকতে হবে এবং কখনই তাঁর স্মরণ থেকে গাফেল হওয়া চলবে না;এতদসহ সবসময়ই তাঁর পবিত্র নামসমূহ উচ্চারণ করতে হবে।

সুফীবাদের প্রথম পর্যায়ে পূর্ণ মনে-প্রাণে শরীয়তের বিধি-বিধানসমূহ মেনে চলতে হবে। কোন ব্যক্তি যদি শরীয়তের নির্ধারিত দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পালন না করে তাহলে তার পক্ষে নিজেকে উচ্চতর স্তরের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব হয় না। ইবনে সিনার মতে,ইবাদত ও আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে আত্মাকে প্রস্তুত হতে হবে যাতে সে নাফসে মুতমায়িন্নাহ্ (প্রশান্ত ব্যক্তিসত্তা) হতে পারে এবং সত্যে উপনীত হবার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

যারা শরীয়তের বিধি-বিধান অনুসরণ করে না তাদের পক্ষে প্রকৃত ইরফানে উপনীত হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। এ ধরনের লোকেরা নিজেদেরকে আরেফ বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা অত্যন্ত অপরিপক্ব,নির্বোধ ও দায়িত্বহীন। একজন সুফী যখন অত্যন্ত সাফল্যের সাথে শরীয়তের স্তর অতিক্রম করেন তখন তিনি তরীকতের স্তরে উপনীত হন এবং আরেফ হিসাবে পরিগণিত হন। কিন্তু যারা শুধু ধর্মের বাহ্যিক রূপ ও দিকসমূহ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে এবং স্বচ্ছ দৃষ্টির অধিকারী হতে পারে না তারা নিচের স্তরেই পড়ে থাকে। যাদের অন্তঃকরণ সত্যের আলোকে আলোকিত হয় নি এরূপ স্বঘোষিত সুফীরা আত্ম প্রবঞ্চনাকারী মাত্র। এ পথের একজন আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান পথিককে অবশ্যই বিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য নির্ধারিত সবগুলো স্তরই অতিক্রম করতে হবে।

তরীকত : বান্দা আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের মধ্য দিয়ে নিজেকে পরবর্তী স্তরে উন্নীত করার জন্য প্রস্তুত করে। এ স্তরকে তরীকত বা সুফীর পথ বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজীদে এরশাদ করেন,

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا

“আর যারা আমাতে চেষ্টা-সাধনা করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার পথসমূহে পরিচালিত করব।” (সূরা আনকাবুত : ৬৯)

শরীয়তের জন্য অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে আন্তরিকতা ও প্রকৃত ঈমান। যারা এ স্তরে উপনীত হয় তারা আধ্যাত্মিক উন্নতির অভিযাত্রার (সায়র ওয়া সুলূক) জন্য প্রস্তুত হয় এবং আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিশুদ্ধতা অর্জনে সক্ষম হয়। এ পথে অভিযাত্রার জন্য একজন পথ প্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। যেমন কবি বলেন :

“এ পথ খিযিরের সাহচর্য ছাড়া অতিক্রম করো না

কারণ এ পথে আঁধার আছে,

তাই পথচ্যুতির বিপদের ভয় করে।”

শেখ মাহমুদ শাবেস্তারীর মতে,তরীকাত হচ্ছে সত্যের পথে পথচারীর (সালেক) বিশেষ সফর। এতে যে সব কাজ অন্তর্ভুক্ত তা হচ্ছে : দুনিয়া বর্জন,আল্লাহর যিকিরের ওপর স্থিতি (সর্বাবস্থায় যিকির),ঐশী সূত্রে মনোসংযোগ কেন্দ্রীভূতকরণ,নির্জনে অবস্থান,অনবরত আনুষ্ঠানিক শারীরিক পবিত্রতায় থাকা,ওযু,সত্যবাদিতা ও আন্তরিকতা ইত্যাদি।

আল কুরাইশী তাঁর ‘রিসালাতুল কুশাইরিয়াহ্’ তরীকতের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে তিনি বলেন,তরীকত হচ্ছে সর্বাবস্থায় শরীয়তের অনুগামী থাকা এবং শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দায়িত্ব-কর্তব্যসমূহ যথাযথভাবে পালন করা। এ সব দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে রয়েছে নৈতিক পবিত্রতা,উন্নত মানবিক গুণাবলী অর্জন,ওলী আল্লাহর পর্যায়ে উন্নীত হবার জন্য চেষ্টা সাধনা করা ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ্ অনুযায়ী আমল করা এবং আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) ও অন্যান্য ইমামগণ এবং ওলী আল্লাহর আদর্শ-চরিত্র ও আচরণ অনুসরণ করা। তরীকতের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে একজন মানুষকে পূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা।

ইবনে সিনার মতে,আধ্যাত্মিক অগ্রগতির প্রথম ধাপ হচ্ছে ব্যক্তির ইচ্ছাকে (ইরাদা) পবিত্রকরণ যা ঈমান থেকে অর্জিত হয়,যে ঈমান ইতিবাচক বা সৎ জীবন-যাপন,নিশ্চিন্ততা ও অন্তরের প্রশান্তির দিকে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি এভাবে ইচ্ছার বিশুদ্ধতা অর্জনের প্রাথমিক পর্যায়ে অগ্রসর হয় তাকে ‘মুরীদ’ (ইচ্ছাকারী) তথা শিষ্য বলা হয়। একজন মুরীদের জন্য সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে এ স্তরে উপনীত হবার জন্য একাগ্রতা ও দৃঢ়তা। এ একাগ্রতা ও দৃঢ়তা তাকে আত্মদমনে অনুপ্রাণিত করে। অর্থাৎ সে তার পাপপ্রবণ নাফসকে (নাফসে আম্মারাহ্) স্বীয় প্রশান্ত নাফস (নাফসে মুত্মায়িন্নাহ্)-এর অনুগত করে নেবে। এ পর্যায়ে উপনীত হবার জন্য একজন শিষ্যকে নিম্নলিখিত তিনটি স্তর অতিক্রম করতে হয় :

১. তাখলিয়াহ্ (تخلية) : এর আভিধানিক অর্থ ‘খালি করা’;পারিভাষিক অর্থে শরীরকে সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করার জন্য নিজেকে প্রবৃত্তির কামনা বাসনা ও ঝোঁকপ্রবণতা থেকে মুক্ত করা।

২. তাহলিয়াহ্ (تحلية) : এর আভিধানিক অর্থ ‘অলঙ্কার দ্বারা সুসজ্জিতকরণ’;পারিভাষিক অর্থ ব্যক্তির নাফসকে উন্নত নৈতিক গুণাবলী দ্বারা ভূষিতকরণ।

৩. তাজলিয়াহ্ (تجلية) : এর আভিধানিক অর্থ ‘আলোকোদ্ভাসিত হওয়া’;পারিভাষিক অর্থ ঐশী সত্তায় নিমজ্জিত হওয়া অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা এক এবং অদ্বিতীয় এবং তিনি ভিন্ন আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই-এ সত্যের যথার্থ স্বীকারোক্তির লক্ষ্যে স্বীয় আমিত্বকে পরিত্যাগ করা। আরেফকে এ সব স্তর অতিক্রম করার পর সাতটি উপত্যকা৭ পার হয়ে যেতে হবে। তা হচ্ছে:

১. তালাব (আকাঙ্ক্ষা ও সন্ধান) : এর মানে হচ্ছে মুরীদের মধ্যে না পাওয়ার বেদনা ও প্রতীক্ষার অনুভূতি। তাঁর অন্তর অদৃশ্যজগতের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষী এবং সর্বত্র প্রিয়তমের সন্ধান করে।

২. ইশক (প্রেম) : এ স্তরে আধ্যাত্মিক পথের পথিক (সালেক) প্রিয়তমের সাথে মিলনের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ও বিচ্ছেদের আগুনে দগ্ধ হন। তিনি প্রিয়তমের সন্ধানে কোন চেষ্টা থেকেই বিরত হন না।

৩. ইরফান : শরীয়ত অনুযায়ী আমল ও তরীকতের পথ অতিক্রম করার পর তাঁর অন্তরে ঐশী ইলমের সূর্য দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে এবং তিনি কম-বেশি ঐশী সত্যকে উপলব্ধি করতে শুরু করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে,এ বিশ্বে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোন শক্তির অস্তিত্ব নেই। তিনি আত্ম উপলব্ধির মধ্য দিয়ে আল্লাহকে উপলব্ধি করার স্তরে উপনীত হন এবং সর্বত্র ঐশী নিদর্শন দেখতে পান।

৪. ইসতিগনা (মুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্তি) : এ স্তরে সালেক আল্লাহ্ ছাড়া সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং শুধু তাঁর দিকেই মনোসংযোগ করেন।

৫. তাওহীদ : সালেক এ স্তরে এসে অনুভব করেন যে,তাঁর হৃদয়ে ঐশী সত্তার একত্বের মর্মবাণী ও তাওহীদের শিখা দেদীপ্যমান হয়ে আছে।

৬. হায়রাহ্ (দিশেহারা অবস্থা) : এ স্তরে সালেক সর্বশক্তিমান ও মহামহিম আল্লাহ তায়ালার সামনে নিজেকে এক দিশেহারা ও হতবুদ্ধি অবস্থায় নিমজ্জিত এবং এক বিস্ময়কর অবস্থার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া দেখতে পান।

৭. ফাকর ওয়া ফানা (দারিদ্র্য ও আত্মবিনয়) : এ স্তরে বহুত্ব একত্বের মাঝে বিলুপ্ত হয় ঠিক যেভাবে ঢেউ সমুদ্রের সত্তায় বিলুপ্ত হয়। এ স্তরের অভিজ্ঞতা অবর্ণনীয় যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

 

সুফীদের করণীয়

 

সুফীদের করণীয় সুফীদের কার্যাবলীকে তিনভাগে ভাগ করা যায় :

১. ইবাদত : শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত বাহ্যিক ইবাদতসমূহ অর্থাৎ নামায,রোযা,খুমস্,যাকাত,জিহাদ ইত্যাদি যা সকল মুসলমান আদায় করে সুফীরাও তা আদায় করেন;এ ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নেই।

২. রিয়াযাত (আধ্যাত্মিক চর্চা) : এর মানে ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণ-মৌখিকভাবে ও অন্তরে আল্লাহ তায়ালার যিকিরের শিক্ষাদান অর্থাৎ প্রকাশ্যে-সশব্দে বা গোপনে-মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করতে হয়। এ ছাড়া চল্লিশ দিনের জন্য নির্জনবাস এবং মুস্তাহাব ইবাদত আঞ্জাম দেয়ার জন্য কোথাও সফর বা সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোথাও অবস্থান এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

৩. বিশেষ নিয়মাবলী মেনে চলা : যেমন খানকার নিয়মাবলী ও পীরের আদেশ-নিষেধসমূহ মেনে চলা। এ ছাড়া ভক্তিমূলক গান-বাজনা ও নাচ এবং আরো কতগুলো কাজ এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এ সব কাজে বিভিন্ন সুফী ধারার মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য ‘মিসবাহুল হিদায়া’,‘মিফতাহুল কিফায়া’,‘কাশফুল মাহজুব’,‘আওয়ারিফুল মা’আরিফ’ প্রভৃতি গ্রন্থের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

কোন কোন ক্ষেত্রে সুফীদের ও শরীয়তের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ দেখা যায়। সুফীদের কাজকর্ম ও ধর্মীয় বিধি-বিধানের মধ্যে অনেক সময় বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে পরস্পরের মতামত খণ্ডন করে বেশ কিছু বই-পুস্তকও লেখা হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা ও গবেষণার জন্য নিম্নলিখিত গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করা যেতে পারে :

‘কিতাবু তাবসিলাতুল আওয়াম’ : সাইয়্যেদ মুরতাযা দাঈ আর রাযী,‘আল ফাসল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া’ : ইবনে হাজম,‘আসরারুত তাওহীদ’ : আল মাজলিসী,আগা বাকের বেহবাহানী,আগা মুহাম্মদ আলী কেরমানশাহী,হাজী মুহাম্মদ জাফর কাবুতার অহাঙ্গী,হাজী মোল্লা যয়নুল আবেদীন আল শিরওয়ানী প্রমুখ (একই শিরোনামে প্রত্যেকের লিখিত)। ‘আর রাওয়াত’,‘মুস্তাদরাকুল ওয়াসায়েল’,‘তারায়েকুল হাকায়েক’ প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এ ছাড়া মোল্লা ইসমাঈল আল খাজাভী (মৃত্যু ১১৭৩ হি.) সত্তার একত্ব (ওয়াহ্দাতুল উজুদ) তত্ত্ব খণ্ডন করে ফার্সী ভাষায় একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। অধিকাংশ সুফী কবিই তাঁদের কবিতায় শরীয়তের কঠোর অনুসারীদের উপহাস করেছেন।

 

হাকীকত (নিরঙ্কুশ সত্য)

ইতঃপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে,শরীয়ত হচ্ছে আল্লাহ্ অভিমুখী পথের স্বীকৃতি,অন্যদিকে তরীকত হচ্ছে আত্মসংশোধন এবং তাখলিয়াহ্,তাহলিয়াহ ও তাজলিয়াহ্ স্তর অতিক্রমের পর পর্যায়ক্রমে সাত উপত্যকা অর্থাৎ তালাব,ইশক,ইরফান,ইসতিগনা,তাওহীদ,হায়রাহ্ ও সবশেষে ফাকর ও ফানাহ্ অতিক্রম করা। আর হাকীকত বা নিরঙ্কুশ সত্যে উপনীত হওয়া মানে পরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়া;এ লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিল এবং তার রুবুবিয়াতের মহিমা প্রত্যক্ষকরণ।

আল লাহিজীর মতে হাকীকত হচ্ছে ঐশী গূঢ় রহস্যের অনাবৃত প্রদর্শনী;ঐশী সত্তার জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবার কারণে সকল ভেদাভেদের কুয়াশা ও মিথ্যা বহুত্ব দূরীভূত হবার মাধ্যমে এ প্রদর্শনী অর্জিত হয়। বলা হয় যে,হাকীকতের প্রথম স্তর হচ্ছে শুহুদ (ঐশী সত্যতা প্রত্যক্ষকরণ) এবং এর সর্বশেষ স্তর হচ্ছে সসীম সত্তার অসীমে অর্থাৎ আল্লাহতে বিলয় ঘটা (ফানা ফীল্লাহ্)। এরপর আসে আল্লাহর সাথে চিরন্তন স্থায়িত্ব লাভ (বাক্বাবিল্লাহ্)। একইভাবে যেহেতু আল্লাহ তায়ালার কালাম অসীম,সেহেতু হাকীকতে উপনীত হওয়ার স্তরসমূহও অসীম।

খাজা আবদুল্লাহ্ আনসারী বলেন,“শরীয়তকে শরীর,তরীকতকে হৃদয় এবং হাকীকতকে আত্মা স্বরূপ গণ্য কর।”

ইবনে সিনা বলেন,“একজন আরেফ আধ্যাত্মিকভাবে ঊর্ধ্বারোহণ করেন এবং পবিত্র সত্তাসমূহের জগতকে প্রত্যক্ষ করেন,তিনি তার এ প্রত্যক্ষণের বর্ণনাদানের ক্ষেত্রে স্বীয় কল্পনাশক্তিকে (খেয়াল) কাজে লাগান। কারণ তার যথাযথ বর্ণনা প্রদান অসম্ভব ব্যাপার এবং তার তাৎপর্য অনুধাবন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব।”৮

তিনি আরো বলেন যে,“প্রত্যয়ের নয়ন (আইনুল ইয়াকীন) যা প্রত্যক্ষ করে তা প্রত্যয়ের জ্ঞানের (ইলমুল ইয়াকীন) মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। সালেক,মুরীদ ও আরেফ কেবল কাশফ ও শুহুদ-এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলন হাসিল করতে সক্ষম হন এবং স্বর্গসুখদায়ক দৃশ্যের নেয়ামত হাসিল করেন। আল্লাহ তায়ালার সাথে এই নৈকট্য ও ঐক্য যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হাসিল করা সম্ভব নয়।”৯

খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী তাঁর ‘শারহুল ইশারাত’ গ্রন্থে যাহেদ,আবেদ ও আরেফের মধ্যকার পার্থক্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,“একজন যাহেদ-যে আরেফ নয়,সে হচ্ছে একজন শিল্পকর্মী বা একজন ব্যবসায়ীর মতো যে তার পণ্যকে অন্যের সাথে (অর্থ বা অন্য পণ্য নিয়ে) বিনিময় করে। আর একজন আবেদ-যে আরেফ নয়,সে হচ্ছে একজন শ্রমিকের ন্যায় যে মজুরীর জন্য কাজ করে। যদিও একজন শিল্পকর্মী ও একজন শ্রমিকের কাজের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে তথাপি উদ্দেশ্যের বিচারে অর্থাৎ বিনিময় ও মজুরীর জন্য কাজ করে বিধায় তারা পরস্পর অনুরূপ। কিন্তু একজন আরেফের যুহদের এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্য সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে স্থায়ীভাবে শুধু আল্লাহর প্রতি মনোযোগী থাকা। তাঁর যুহদ হচ্ছে তাঁর বিবেকের বা অভ্যন্তরীণ সত্তার এক ধরনের বিশুদ্ধকরণ যার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য যে কোন কিছুতে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকা। তিনি আল্লাহ তায়ালার প্রতি এমনভাবে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন যে,তিনি অন্য কোন কিছুর দিকেই ভ্রূক্ষেপ করেন না এবং অন্য সবকিছুর প্রতিই বিরাগ পোষণ করেন। আরেফ কেবল পরম সত্তার সন্ধানে ব্যস্ত থাকেন এবং অন্য কোন কিছুর সন্ধান করেন না। তিনি এ কারণে ইবাদত করেন যে,কেবল আল্লাহ তায়ালাকে ইবাদত পাবার হকদার বলে মনে করেন। আরেফ ভয় অথবা পুরস্কারের লোভে ইবাদত করেন না। তিনি বেহেশত পাবার আশায় আল্লাহকে ভালোবাসেন না,বরং আল্লাহ্ই যেহেতু তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য শুধু সে কারণেই তাঁকে ভালোবাসেন।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) বলেন,“হে আমার রব! আমি জাহান্নামের ভয়ে বা জান্নাতের আশায় আপনার ইবাদত করি না। যেহেতু আমি কেবল আপনাকেই ইবাদতের যোগ্য বলে মনে করি কেবল এ কারণেই আপনার সামনে আমার মাথা নত করি।”

 

ইরফানের কযেকটি সুগভীর তত্ত্ব

১. তাওহীদ (একত্ব) : আরেফগণের মতে বহুত্বের কোন অস্তিত্ব নেই। সকল বাস্তবতা (হাকীকত) অনিবার্যভাবেই এক। মানুষের রূহ ও নাফস তাদের বহুত্ব সত্ত্বেও এক। বহুত্ব হচ্ছে স্থান ও কালের তৈরি বিভিন্ন প্রকরণ এবং তা কেবল বস্তুজগতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আত্মিক জগতে একত্ব (ওয়াহ্দাত) ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। যেহেতু রূহ হচ্ছে আদেশের জগৎ (আলম আমর)১০-এর বিষয় সেহেতু তা বহুত্বের ঊর্ধ্বস্থিত বিষয়। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا

“তারা আপনাকে রূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে;বলুন : রূহ হচ্ছে আমার রবের আদেশ থেকে (উদ্ভূত),আর তোমাদেরকে তো খুব সামান্যই জ্ঞান দেয়া হয়েছে।” (বনী ইসরাঈল : ৮৫)

কোরআন মজীদে আরো এরশাদ হয়েছে :

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ

“তিনিই তোমাদেরকে একটি মাত্র নাফস (ব্যক্তিসত্তা) থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আল আরাফ : ১৮৯)

আত্মার একত্বকে সাধারণত একটি আলোর উপমা দিয়ে বুঝানো হয় যা বিভিন্ন রঙের আয়নায় প্রতিফলিত হলে তার প্রতিফলন বিভিন্ন রঙের হবে। কবি বলেন :

“এ জগতের সবটাই ছিল বিভিন্ন ধরনের কাঁচ

তাতে অস্তিত্বের আলোকপুঞ্জের রশ্মি নিপতিত হলো,

যে কাঁচের রঙ লাল,হলুদ বা নীল ছিল

সে কাঁচে ঐ আলো সে রঙই ধারণ করল।”

এ সৃষ্টিলোক হচ্ছে একটি ঢেউ অথবা একটি বুদবুদের ন্যায় যা দৃশ্যমান,কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার কোন অস্তিত্ব নেই;এ ক্ষেত্রে সমুদ্র হচ্ছে একমাত্র সত্য। সৃষ্টিলোকের বাস্তবতাকে সূর্যরশ্মির সাথে তুলনা করা চলে;সূর্যরশ্মি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে,কিন্তু প্রকৃত সত্য শুধু সূর্য। মাওলানা রুমী বলেন :

“আমরা অভিন্ন ছিলাম১১ এবং সকলে একটিমাত্র মুক্তা ছিলাম

আমরা ছিলাম শরীরবিহীন,আর তা-ই সকলের গূঢ় রহস্য,

আমরা ছিলাম সূর্যের মতো একটি মুক্তা

জটিলতাহীন আর পানির মতো স্বচ্ছ ছিলাম।”

তিনি আরো বলেন,

“ঐ পরম জ্যোতি যখন রূপ পরিগ্রহ করল

দুর্গোপরি টিবিসারির ছায়াসম বহুগুণিত হলো,

টিবিশ্রেণিকে কামানের গোলা নিক্ষেপে ধ্বংস করে দাও

যাতে তাদের মধ্যকার পার্থক্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।”

আরেফগণের পরিভাষায় সত্য এক এবং তার বহিঃপ্রকাশ সর্বত্র। প্রতিটি জিনিসই আল্লাহ তায়ালার চিহ্ন বা নিদর্শন;ঐশী জ্যোতি সকল সৃষ্টিতেই প্রতিফলিত। কোরআন মজীদে বলা হয়েছে যে,মানুষের শরীর কাদামাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবং তাতে ঐশী চেতনা ফুঁকে দেয়া হয়েছে (সূরা সাদ : ৭১-৭২)। যা কিছু প্রকৃত তা-ই সত্য এবং তা এক,আর যা কিছু সত্য ও এক তা-ই চিরন্তন। অতএব,রূহ হচ্ছে ঐশী ঝলক (তাজ্জালী) এবং এ কারণে তা চিরন্তন,তা সৃষ্ট নয়।

আরেফগণের বিশ্বদৃষ্টি অনুযায়ী ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের প্রকৃতপক্ষে কোন বাহ্যিক অস্তিত্ব নেই,বরং তা একটি আয়নার পেছন দিককার সমতুল্য;আত্মা হচ্ছে আয়নার সামনের দিকের ন্যায়। এ বিশ্বজগৎ হচ্ছে শরীরতুল্য এবং আল্লাহ তায়ালা তার আত্মাস্বরূপ। আত্মা হচ্ছে এক এবং একক।

আল্লাহ তায়ালা,রূহ ও ব্যক্তিসত্তা বা নাফসের মধ্যকার সম্পর্ক তিনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে,তা হচ্ছে :

ক. সৃষ্টি (خلق)

খ. দেহধারণ (حلول) ও

গ. বহিঃপ্রকাশ (صدور)-ঈশ্বর থেকে সৃষ্টির নিষ্পন্ন হওয়ার তত্ত্ব : নিউ প্লেটোনিক দর্শন

সৃষ্টি (খালক)-এর মতবাদ একটি সেমিটিক মতবাদ। আর দেহধারণ (হুলুল)-কে খ্রিস্টীয় মতবাদের আলোকে অর্থাৎ হযরত ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র গণ্যকারী খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়। আর বহিঃপ্রকাশ (সুদুর) তত্ত্বের উৎস হচ্ছে নব্য প্লেটোনিক দর্শন। আরেফগণ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনের জন্য এ তিনটি তত্ত্বকেই ব্যবহার করেছেন। কবি বলেন :

“এক ডিম্বসম মুক্তা উচ্ছ্বসিত হলো ও সাগরে পরিণত হলো

তাতে ফেনা হলো,ফেনা থেকে জমিন হলো,আর ধোঁয়া থেকে হলো আসমান

যদিও ঝিনুক উপকূল থেকে একটি ফোটা হরণ করল আর হারিয়ে গেল

যে ডুবুরি তাকে চিনতে পেরেছে সে তাকে সাগরেই সন্ধান করে।”

সুফিগণ অনেক সময় বহিঃপ্রকাশকে (সুদুর) ব্যাখ্যা করেন পরম সুন্দরকে পাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা হিসাবে,যে পরম সুন্দর তাজাল্লী রূপে দেখা দেন। এ কারণে কবি আবদুর রহমান জামী

كنت كترا مخفيا (আমি ছিলাম এক গুপ্ত ধনভাণ্ডার)-

এ হাদীসে কুদসীকে তাঁর কবিতায় ‘চিরন্তন সৌন্দর্য’ ও ‘তাঁকে দেখার উদগ্র বাসনা’ অর্থে ইউসুফ ও যুলাইখা রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। বহিঃপ্রকাশ ও দেহধারণ তত্ত্বের সমন্বিত রূপ এভাবে পেশ করা হয়েছে যে,যদিও মানুষ সৃষ্টি বৈ নয়,তবে তাকে খোদায়ী গুণে গুণান্বিত করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কারণে বলা হয়,

خلق الله آدم على صورته

“আল্লাহ্ আদমকে তাঁর নিজ গুণে গুণান্বিত করে সৃষ্টি করেছেন।”

সৃষ্টি ও দেহধারণ-এর ধারণাকে পানি ও মহাসাগরের উপমা আকারে পরস্পর সমন্বিত করা হয়েছে। মাওলানা রুমী বলেন,

“সেদিন আমি ছিলাম যখন নামসমূহ ছিল না

নামধারী কোন অস্তিত্বের চিহ্নও ছিল না

‘আমাদের’ থেকে নামধারী ও নামসমূহ আত্মপ্রকাশ করল

সেই দিন থেকে যেদিন ‘আমি’ ও ‘আমরা’ ছিল না।”

মানুষের ইচ্ছা আসলে আল্লাহর ইচ্ছামাত্র। আর যা কিছু অস্তিত্ববান এবং যা কিছু অস্তিত্বহীন তার সবকিছুই তিনি। আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান। ‘মানতেকুত তায়র’১২-এ প্রদত্ত সি-মোরগের১৩ উপমা এবং সুফী সাহিত্যে প্রদত্ত অন্যান্য উপমা সুফীতাত্ত্বিক তাওহীদে সর্বেশ্বরবাদ বা অভেদবাদের উপাদানই নির্দেশ করে। আল্লাহ্ হচ্ছেন আসমানসমূহ ও জমিনের জ্যোতি। তিনি হচ্ছেন এক এবং চিরন্তন। তিনি সবকিছু জানেন এবং তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি অনাদিকাল থেকে আছেন এবং অনন্তকাল পর্যন্ত থাকবেন। সমগ্র সৃষ্টিলোকই তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে এবং তিনি তাঁর নিকটতম বান্দাদের নিকট নিজেকে প্রদর্শন করেন।

২. আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন-প্রেম : মাওলানা রুমী বলেন,

“যে তার নিজ থেকে দূরে পড়ে রয়েছে

নিজের সাথে পুনর্মিলনের চেষ্টাই হোক তার জীবনের সাধনা।”

ইরফানী সাহিত্যে আল্লাহ্ থেকে আত্মার বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আলোচনা করা হয়,বরং একে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য বা অনিবার্য বাস্তবতা হিসাবে গণ্য করা হয়। বলা হয় যে,মানুষের আত্মাসমূহ এক সময় আল্লাহ তায়ালার সত্তার নৈকট্যে অবস্থান করছিল,কিন্তু পরে তা পৃথক হয়ে যায়। তাই আত্মা এখন তার বিচ্ছেদের বেদনায় বিলাপ করছে এবং পূর্নমিলনের জন্য উতলা হয়ে আছে। স্বীয় মুল বা উৎসে প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্ক্ষা দ্বারাই সে সবসময় পরিচালিত হয়।

আরেফগণের বিশ্বাস অনুযায়ী এ আকর্ষণের পেছনে প্রেমের শক্তি ক্রিয়াশীল যা বিচার-বুদ্ধি থেকে স্বতন্ত্র একটি উপাদান। পরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়া অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলিত হবার এটিই একমাত্র পথ।

আরেফগণের মতে বিচার-বুদ্ধি হচ্ছে মশাল ও পথপ্রদর্শক সমতুল্য,কিন্তু পরম সত্যাভিমুখী প্রকৃত পথ হচ্ছে প্রেম। প্রেমকে দু’ধরনের বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ”

১. বাহ্যিক বা দৈহিক প্রেম : (ইশকে সুরী ও যাহেরী) : এর মানে হচ্ছে যা কিছু দৃশ্যত ও বাহ্যত সুন্দর তার প্রতি আকর্ষণ।

২. অভ্যন্তরীণ বা প্রকৃত প্রেম (ইশকে বাতেনী ও হাকীকী ) : যেহেতু যা কিছু সুন্দর তা-ই আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্য ও পূর্ণতার প্রতিফলন,সেহেতু বাহ্যিক প্রেমের মধ্য দিয়ে প্রকৃত প্রেমের স্তরে উপনীত হওয়া সম্ভব।

প্রেম ও বিচার-বুদ্ধির মধ্যকার বিরোধ ও বৈপরীত্য সব সময়ই সুফী সাহিত্যের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হিসাবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। মানুষের মধ্যে এ দু’টি শক্তির প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। অনুরূপভাবে সুফী সাহিত্যে শরীয়তের বিধি-বিধান ও প্রেমের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

সংক্ষেপে বলা চলে যে,প্রেম হচ্ছে আধ্যাত্মিক তৎপরতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সত্তাকে বিশোধনের একটি পদ্ধতি। হৃদয় বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন হবার পর আল্লাহ তায়ালার নূর গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত হয়।

রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেছেন :

تخلقوا باخلاق الله

“তোমাদের নিজেদেরকে আল্লাহর গুণাবলীতে গুণান্বিত কর।”

হৃদয় যখন এমন একটি আয়নায় পরিণত হয় যাতে আল্লাহ তায়ালার বহিঃপ্রকাশসমূহ (মাযাহের) প্রতিফলিত হয়,তখন তাতে প্রকৃত বাস্তবতা তথা সত্য মুদ্রিত হয়ে যায় এবং তাতে সুস্পষ্ট দৃশ্য দেখা যায়। অতঃপর মানুষ যা কিছুই দেখে তাতে আল্লাহকেই দেখা যায়। আর এ স্তরেই প্রকৃত ঐক্য (ওয়াহ্দাত) ও পূর্ণতা (কামালিয়াত) অর্জিত হয়।

৩. তাওয়াক্কুল : সুফীবাদের অন্যতম মৌলিক আকীদা হচ্ছে তাওয়াক্কুল অর্থাৎ সকল বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরতা ও তাঁর ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পণ। বস্তুত আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ (তাসলীম) এবং তাঁর প্রতি সর্বাবস্থায় সন্তুষ্ট থাকাকে (রেযা) ইসলামী মরমীবাদের স্তম্ভ হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সুফিগণ ইসলাম বলতে আত্মসমর্পণ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও তাঁর নির্ধারিত বিধান সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়াকেই বুঝিয়ে থাকেন। সুফীদের বিশ্বাস এই যে,আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি মানুষের ভাগ্যকেই পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। (এর ভিত্তিতেই কতক সুফী নির্জন বাস অবলম্বন করেন এবং কোন কাজ-কর্ম করা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকেন।) অবশ্য অন্যদের আকীদা হচ্ছে এই যে,আল্লাহ তায়ালা মানুষকে কর্মপ্রচেষ্টার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার প্রদান করেছেন এবং এ ক্ষমতা ও ইখতিয়ার ব্যবহার করে কাজের মাধ্যমে আমাদেরকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,

ليس للأنسان اّلا ما سعى

“মানুষের জন্য কেবল তা-ই আছে যে জন্য সে চেষ্টা-সাধনা করেছে।”

এক ব্যক্তি সারী আস সাদিকীর নিকট এসে বলল : “পাহাড়ে অবস্থানরত অমুক ব্যক্তি আপনাকে সালাম দিয়েছেন।” জবাবে তিনি বললেন,“যেহেতু সে পাহাড়ে বসবাস করে,(আমাদের সাথে) তার কোন কাজ নেই;বরং যা উচিত তা হচ্ছে একজন লোক বাজারে যাবে,সেখানে কর্মব্যস্ত থাকবে,কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহ তায়ালাকে ভুলবে না।”

মাওলানা রুমি মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তাওয়াক্কুলের মূলনীতিকে স্বীকার করতেন,কিন্তু পাশাপাশি জীবনের জন্য কর্ম ও প্রচেষ্টাকে অপরিহার্য গণ্য করতেন। তিনি বলেন,

“বললেন হ্যাঁ,তাওয়াক্কুল যদি পথ প্রদর্শক হয়ে থাকে

তো এই কার্যকারণও রাসূলের সুন্নাত

রাসূল উচ্চৈঃস্বরে বললেন : তাওয়াক্কুলের সাথে সাথে উটের হাঁটুকেও বেধে রাখ

‘শ্রমিক আল্লাহর বন্ধু’-এ কথার গূঢ় তাৎপর্য শোন

তাওয়াক্কুলের কারণে কার্যকারণ থেকে গাফেল হয়ো না।”

আল্লাহ তায়ালা এ জগতে ভালো-মন্দ এবং সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণের সুযোগ দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে,মানুষ যেন স্বেচ্ছায় তাওয়াক্কুল ও আল্লাহর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিজের অভ্যন্তরে (ঈমানের) কষ্টিপাথর তৈরি করে নিতে পারে। এ ধরনের মানুষ সকল প্রকার বিপদাপদ ও প্রতিকূলতাকে বরণ করে নেয়,কিন্তু সর্বাবস্থায়ই সবকিছুতেই সৌন্দর্য আবিষ্কার করে।

পাদটীকা :

১. ‘আসহাবে সুফ্ফা’ মানে ‘বারান্দায় বসবাসকারিগণ’। যে সব সাহাবী মসজিদে নববীতে বসবাস করতেন তাঁদেরকে এ নামে অভিহিত করা হয়। আবুল ফিদা তাঁদের সম্পর্কে লিখেছেন : “তারা ছিলেন দরিদ্র বহিরাগত;তাঁদের মদীনায় কোন বন্ধু-বান্ধব বা বাসগৃহ ছিল না। তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর হাতে বাইয়াত হন এবং তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এভাবে মসজিদের বারান্দা তাঁদের বাসস্থানে পরিণত হয় এবং এ থেকেই তাঁরা এ নামে অভিহিত হন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন খাবার খেতেন তখন তাঁদের মধ্য থেকে কতককে ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন এবং অন্যদেরকে খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন সাহাবীকে দায়িত্ব দিতেন।” এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য হাফেয আবু নাঈম আল ইসফাহানী লিখিত ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’ এবং আল হুজাবিরী লিখিত ‘কাশফুল মাহজুব’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।

২. উমাইয়্যা শাসনমলে তাদের অনুসারী আরবরা নিজেদেরকে অনাবরবদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর বলে দাবি করত এবং অনারবদেরকে হেয় প্রতিপন্ন ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। তারা অনারবদের ওপর নিজেদের সামাজিক রীতি-নীতি ও আদব-কায়দা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনারবদের মধ্যে, বিশেষ করে ইরানীদের মধ্যে একটি দল স্বীয় জাতীয় সংস্কৃতি-সভ্যতা,আদব-কায়দা ও গৌরবময় ইতিহাসকে বহু পুস্তকের মাধ্যমে বিশেষত কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরার ও শ্রেষ্ঠতর প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। এরাই ‘শুয়ূবিয়্যাহ্’ নামে পরিচিত হয়।

৩. হিজরী ১৬৩-২৫৫

৪. আল জামী লিখিত ‘নাফাহাতুল উনস’।

৫. শায়খুল ইশরাক শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী ও সাদরুল মুতাআল্লেহীন শিরাজী (মোল্লা সাদরা)-এর গ্রন্থাবলীতে পাহলাভিয়্যাত সম্পর্কে উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।

৬. পারিভাষিক অর্থে বর্তমানে সেমিটিক বলতে (ধর্মীয় জনগোষ্ঠী অর্থে) ইহুদীদেরকে বুঝানো হয়।-    অনুবাদক

৭. সানায়ী তাঁর ‘সায়রুল ইবাদ ইলাল ইবাদ’ গ্রন্থে এবং আত্তার তাঁর ‘মানতিকুত তায়র’ গ্রন্থে এ স্তরগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন।

৮. ইবনে সিনা : আল ইশারাত,নবম ভাগ,ফার্সী অনুবাদ,পৃ. ৫৪।

৯. প্রাগুক্ত।

১০. শহীদ আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হোসেন বেহেশতী তাঁর লেখা ‘কোরআন এবং আলমে খালক ও আলমে আমর তত্ত্ব” শীর্ষক প্রবন্ধে (Al-Tawhid, Vol 1, No. 2  দ্রষ্টব্য) আলমে খালক ও আলমে আমর বিষয়ক পুরো তত্ত্বটিই প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন,এটি একটি কোরআন বহির্ভুত তত্ত্ব যা মুতাকাল্লিমগণ কর্তৃক বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে।- Editor, Al-Tawhid

১১. منبسط এর আভিধানিক অর্থ ‘সম্প্রসারিত;পারিভাষিক অর্থে ‘অবিভাজ্য’।-অনুবাদক

১২. শেখ ফরিদ্দুদীন আত্তার লিখিত।

১৪. রূপকথার বৃহত্তম কাল্পনিক পাখি যা মানুষের মতোই কথা বলে এবং কাফকায (ককেশাস) পর্বতে বসবাস করে বলে ‘শাহনামা’য় উল্লেখ করা হয়েছে-যে পাখি মানুষের কল্যাণকামী ও সত্য-ন্যায়ের পৃষ্ঠপোষক।-অনুবাদক

(জ্যোতি, ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা)


source : alhassanain
0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও ...
‘ইমাম হুসাইন (আ.)’র বিপ্লবই ...
ফিলিস্তিনি বালিকা
পরকালের জন্য প্রস্তুতি এবং ...
ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়াকে কখনও ...
নেয়ামতের হাত ছড়া হওয়ার কারন
হযরত মুসা (আ.)'র মু'জিজার কাছে ...
মহানবী (স.) হতে বর্ণিত ৪০টি হাদীস (২)
গাদিরে খুম

 
user comment