বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

একমাত্র অবিকৃত ঐশী গ্রন্থ : আল কোরআন

একমাত্র অবিকৃত ঐশী গ্রন্থ : আল কোরআন

ঐশী গ্রন্থ হিসেবে দাবীকৃত সকল গ্রন্থের মধ্যে একমাত্র কোরআন মজীদেরই ঐতিহাসিক প্রামাণ্যতা রয়েছে। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)ই যে ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করে এ কিতাব মানুষের সামনে পেশ করেছেন - এ বিষয়ে কোনোরূপ ঐতিহাসিক বিতর্ক বা সংশয় নেই।

যে সব (অমুসলিম) পণ্ডিত-গবেষক হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে আল্লাহর নবী বলে মনে করেন না, বরং বিরল প্রতিভাধর মহাজ্ঞানী বলে মনে করেন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব বলে মনে করেন না; তাঁরা এ মহাগ্রন্থকে স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কর্তৃক রচিত বলে মনে করেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই যে, বর্তমানে প্রচলিত কোরআন মজীদই হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কিতাব; এ কিতাব পরবর্তীকালে কেউ রচনা করে তাঁর ওপর নাযিলকৃত কিতাব বলে চালিয়ে দেয় নি। তাছাড়া সারা দুনিয়ায় এ গ্রন্থের একটিই মাত্র সংস্করণ প্রচলিত আছে। কোথাও যদি কোনো মুদ্রণে কোনোরূপ সামান্যতম ছাপার ভুলও ঘটে, তো সাথে সাথে কেউ না কেউ সে ভুল নির্দেশ করেন এবং পূর্ব থেকে চলে আসা মুছ্ব্হাফ্ (কোরআন মজীদের কপি)-এর সাথে মিলিয়ে নিয়ে তা সংশোধন করে নেয়া হয়।

সর্বসম্মত মত অনুযায়ী, কোরআন মজীদ দীর্ঘ তেইশ বছরে অল্প অল্প করে নাযিল হয় এবং যখন যতোটুকু নাযিল হয় সাথে সাথেই তা লিপিবদ্ধ ও সমকালীন বহু মুসলমান কর্তৃক মুখস্ত করা হয়। কিন্তু যে ধারাক্রমে তা নাযিল হয় হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নির্দেশক্রমে তা থেকে ভিন্ন এক বিন্যাসে গ্রন্থাবদ্ধ ও মুখস্ত করা হয়। যখনই কোনো সূরাহ্ বা আয়াত নাযিল্ হয় তখনই তিনি তাঁর ওয়াহী লেখকদেরকে ও অন্যান্য ছ্বাহাবীকে জানিয়ে দেন যে এ সূরাহ্ বা আয়াতের অবস্থান ইতিপূর্বে নাযিলকৃত কোন্ সূরাহ্ বা কোন্ আয়াতের আগে বা পরে হবে।

কোরআন মজীদ এ বিন্যাসেই লেখা হয়, ছ্বাহাবীগণ মুখস্ত করেন এবং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ও তাঁর ছ্বাহাবীগণ তেলাওয়াত্ করেন। এভাবে দীর্ঘ তেইশ বছরে এ কাজ সমাপ্ত হয়। হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের প্রায় তিন মাস আগে বিদায় হজ্বের সময় কোরআন মজীদের সর্বশেষ আয়াত নাযিল হয় এবং সাথে সাথেই পুরো কোরআন মজীদ লিখিতভাবে ও শত শত হাফেয্ ছ্বাহাবীর স্মৃতিতে অভিন্ন বিন্যাসে গ্রন্থাকারে সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়।

কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধকরণের কাজ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতী যিন্দেগীর শুরুতেই মক্কাহ্ নগরীতেই শুরু হয়। তখন ছ্বাহাবীদের মধ্যে যারা লেখাপড়া জানতেন তাঁরা যখনই কোরআন মজীদের কোনো সূরাহ্ বা আয়াত নাযিল হতো তখনই হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নির্দেশিত অবস্থান অনুযায়ী লিখে রাখতেন। ফলে এর বিন্যাসে মুহূর্তের জন্যও কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় নি, কেবল ধীরে ধীরে এর আয়তনই বৃদ্ধি পেয়েছে। হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) মক্কাহ্ নগরীতে থাকাকালেই যে ছ্বাহাবীগণ লিখিত কোরআন পাঠ করতেন এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য ও দৃষ্টান্তও রয়েছে।

হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) মক্কাহ্ থেকে মদীনায় হিজরত করার পর স্বাভাবিকভাবেই কোরআন মজীদের আয়তন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর সেই সাথে সেখানে কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধকরণ ও মুখস্তকরণের কার্যক্রম ব্যাপকবিস্তৃত রূপ লাভ করে। বিশেষ করে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) তাঁর ছ্বাহাবীদেরকে লিখন-পঠন শিক্ষা দেয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন; এমনকি ছ্বাহাবীদেরকে লিখন-পঠন শিক্ষা দেয়ার বিনিময়ে তিনি যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্ত করে দেয়ার কার্যক্রমও গ্রহণ করেন। আর এভাবে যে সব ছ্বাহাবী লেখাপড়া শিক্ষা করেন তাঁদের এ অক্ষরজ্ঞান কাজে লাগাবার প্রধান ক্ষেত্র, বরং বলা চলে যে, একমাত্র ক্ষেত্র ছিলো কোরআন মজীদ কপিকরণ ও তা থেকে দেখে দেখে পাঠকরণ। এই সাথে মুখস্তকরণের কার্যক্রম অধিকতর ব্যাপকভাবে চলতে থাকে।

রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় যারা কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধকরণের কাজ করতেন তাঁদেরকে “কাতেবে ওয়াহী” বলা হতো; বিভিন্ন সূত্রে এ ধরনের ৪৫ জন কাতেবে ওয়াহী ছ্বাহাবীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া তাঁর জীবদ্দশায়ই পুরো কোরআন মুখস্ত করেছিলেন এমন ২৩ জন ছ্বাহাবীর নাম উল্লেখ আছে।

ফলতঃ অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পর কিছুদিনের মধ্যেই পুরো কোরআন মুখস্তকারী ছ্বাহাবীর সংখ্যা শত শত জনে দাঁড়ায়। অতঃপর পুরো কোরআন মুখস্তকারীদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে চলতে থাকে এবং তৃতীয় খলীফাহর যুগ পর্যন্ত পুরো কোরআন মুখস্তকারী (হাফেযে কোরআন)-এর সংখ্যা হাজার হাজারে উপনীত হয়।

এখানে একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) যে পুরো কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করিয়ে রেখে গিয়েছিলেন এ ব্যাপারে কোনোরূপ দ্বিমত বা বিতর্ক নেই। এমতাবস্থায় তাঁর রেখে যাওয়া মুছ্বহাফ্ (কোরআনের কপি), ছ্বাহাবীগণের অনেকের লিখিত ব্যক্তিগত মুছ্বহাফ্ এবং তাঁর জীবদ্দশায় পুরো কোরআন মুখস্তকারী হাফেযগণের হেফয মিলিয়ে পুরো কোরআন মজীদ তাঁর ইন্তেকালের পরে সাথে সাথে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মুতাওয়াতির্ সূত্রে পরবর্তী লোকদের কাছে কাছে পৌঁছে যায় - যে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের বা দ্বিমতের অবকাশ নেই। শুধু তা-ই নয়, রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) ইন্তেকাল-পরবর্তী লোকদের কাছে তাঁর রেখে যাওয়া পুরো কোরআন নির্ভুলভাবে পৌঁছার ব্যাপারে ছ্বাহাবীদের মধ্যে যে মতৈক্য (ইজমা‘) ছিলো - এ ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ করার মতোও কোনো অকাট্য তথ্য পাওয়া যায় না। এ ইজমা‘র কারণেই, খুবই অল্প সময়ের মধ্যে পুরো কোরআন মুখস্তকারী হাজার হাজার হাফেযে কোরআন গড়ে ওঠেন, অথচ কোরআনের পাঠ (text) সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে সামান্যতমও মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় নি।

কোরআন মজীদের মূল প্রামাণ্যতা অর্থাৎ এ কিতাব যে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) মানুষের সামনে পেশ করে গেছেন - এটা একটা সর্বজনস্বীকৃত অকাট্য সত্য। কিন্তু এতে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় তাঁর ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অথবা তাঁর ইন্তেকালের পরে, কিছু সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে কিনা - এ মর্মে ইসলাম-বিরোধী প্রাচ্যবিদগণের অনেকের ও খৃস্টান মিশনারীদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের মনে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ ‘আক্বাএদের প্রাথমিক আলোচনায় যখন কোরআন মজীদ বাদে অন্য সমস্ত ধর্মীয় গ্রন্থের প্রামাণ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিচারবুদ্ধির রায়ে বাতিল হয়ে যায় তখন তাঁদের অনেকে স্বীকার করেন যে, হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) আল্লাহর নবী এবং কোরআন মজীদ আল্লাহর কিতাব। তবে সাথে সাথে তাঁরা কোরআন মজীদে অল্প হলেও কিছু বিকৃতি সাধিত হয়েছে বলে দাবী করেন। তাই এ বিষয়টির ওপর কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে প্রথম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় কোরআন মজীদে তাঁর ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কোনোরূপ হ্রাস-বৃদ্ধি বা বিকৃতি আদৌ সম্ভব ছিলো কিনা।

এ বিষয়ে সংক্ষেপে বলতে হয় যে, শুধু হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)ই নন, বরং সকল নবী-রাসূলই (‘আঃ) ছিলেন সকল প্রকার পাপ ও অজ্ঞতাপ্রসূত কথনের অপরাধ থেকে মুক্ত। বিচারবৃদ্ধির দৃষ্টিতে, কোনো নবীর পক্ষে গুনাহ্ করা ও ভুল কথা বলা অসম্ভব এবং তাঁদেরকে গুনাহ্ ও ভ্রান্ত কথন থেকে রক্ষা করা আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য যরূরী। কারণ, অন্যথায় মানুষের মন একজন নবীকে নবী বলে প্রত্যয়ের অধিকারী হতে পারতো না এবং সে ক্ষেত্রে নবীর ব্যাপারে তাদের জন্য আল্লাহর হুজ্জাত্ পূর্ণ হতো না। ফলে তারা নবীকে নবী হিসেবে মনে করতে না পারার কারণে প্রত্যাখ্যান করায় শাস্তিযোগ্য হতো না।

অবশ্য অনেকে মনে করেছেন যে, কোরআন মজীদের কতক আয়াত থেকে কয়েক জন নবী (‘আঃ) গুনাহ্ করেছিলেন বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু আসলে তাঁরা ঐ সব আয়াতের সঠিক তাৎপর্য বুঝতে পারেন নি।

[নবী-রাসূলগণের (‘আঃ) পাপমুক্ততা (‘ইছ্ব্মাতুল্ আম্বিয়া’) একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচ্য বিষয়। এ বিষয়ে আমার প্রণীত জীবন জিজ্ঞাসা গ্রন্থে বিচারবুদ্ধির আলোকে সংক্ষেপে ও রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত্ ও বিবিগণ গ্রন্থে অপেক্ষকৃত বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে এবং বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের আলোকে পূর্ণাঙ্গ আলোচনার লক্ষ্যে নবী-রাসূলগণের (‘আঃ) পাপমুক্ততা শীর্ষক গ্রন্থ প্রণয়নের কাজে হাত দেয়া হয়েছে; এ গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি অনেক আগেই প্রস্তুত হয়েছে; আল্লাহ্ তা‘আলা তাওফীক্ব্ দিলে এটির পূর্ণতাবিধান করে পাঠক-পাঠিকাদের সামনে হাযির করা হবে।]

বিশেষভাবে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) সম্বন্ধে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:

“আর তিনি প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না; তা (তিনি যা কিছু বলেন তা) তাঁর নিকট প্রত্যাদেশকৃত ওয়াহী ব্যতীত আর কিছুই নয়।” (সূরাহ্ আন্-নাজম: ৩-৪)

[এখানে ওয়াহী বলতে কোরআনের আয়াত হিসেবে পেশকৃত কথা এবং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর শিক্ষা ও তথ্যমূলক যে কোনো কথাই শামিল রয়েছে। এর মধ্যে কোরআনের আয়াত হচ্ছে তেলাওয়াত্যোগ্য বা পঠনীয় ওয়াহী এবং অন্যান্য বক্তব্য হচ্ছে তেলাওয়াত বহির্ভূত ওয়াহী - যার মূল তাৎপর্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত হলেও তার বাক্য ও শব্দচয়ন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর।]

বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে নবুওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে এটা একেবারেই অসম্ভব যে, তিনি স্বয়ং আল্লাহর কালামে পরিবর্তন সাধনের মতো ধৃষ্টতার পরিচয় দিতে সাহসী হবেন। আল্লাহ্ তা‘আলার শা’নে যারা ধৃষ্টতার পরিচয় দেয় এবং ধৃষ্টতাবশতঃ তাঁর নামে মিথ্যা বলে তাদের এ দুঃসাহসিক কাজের পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার পরিচয়ের সাথে সঠিকভাবে পরিচিত না থাকা এবং তাঁর অস্তিত্ব ও গুণাবলী সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণার অধিকারী হওয়া। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে সরাসরি সম্পর্কের অধিকারী একজন নবীর পক্ষে এরূপ ধৃষ্টতার প্রশ্নই ওঠে না। অতএব, রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কোরআন মজীদে কোনোরূপ হ্রাস-বৃদ্ধি বা বিকৃতি সাধনের কথা কল্পনাও করা যায় না।

এরপরও যদি আমরা তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে, যেহেতু নবীও ইচ্ছাশক্তি এবং স্বাধীনতা ও এখতিয়ারের অধিকারী একজন মানুষ সেহেতু তাঁর পক্ষে কোনো না কারণে আল্লাহর কালামে পরিবর্তন সাধনের চিন্তা করা অসম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলা কি তাঁকে তা করার সুযোগ দেবেন?

বস্তুতঃ স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন এবং লোকেরা বিচারবুদ্ধির আলোকে তাঁর অতীত জীবনাচরণ পর্যালোচনা করে তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নেয়ার এবং তাঁর পক্ষ থেকে কোরআন হিসেবে উপস্থাপিত বক্তব্যকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব হিসেবে গ্রহণ করে নেয়ার পরে তিনি যদি তাতে রদবদল করেন এবং এর ফলে লোকেরা হেদায়াত্ থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে তাদেরকে সে পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করার উপায় কী? এরূপ অবস্থায় তো লোকদেরকে পাকড়াও করা আল্লাহ্ তা‘আলার ন্যায়বিচারক বৈশিষ্ট্যের বরখেলাফ হবে। সুতরাং বিচারবুদ্ধির দাবী হচ্ছে এই যে, নবী যদি স্বেচ্ছায় তাতে কোনো পরিবর্তন সাধন করতে উদ্যোগী হন তাহলে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলার দায়িত্ব হচ্ছে এতে হস্তক্ষেপ করা এবং কোরআনে বিকৃতিসাধন প্রতিহত করা। স্বয়ং কোরআন মজীদও এ কথাই বলছে, এরশাদ হয়েছে:

“আর তিনি যদি আমার নামে (নিজ থেকে) কতক কথা বলেন তাহলে অবশ্যই আমি তাঁর ডান হাত ধরে ফেলবো (তাঁকে পাকড়াও করবো), এরপর অবশ্যই তাঁর গর্দান কেটে ফেলবো (ঘাড় মটকে দেবো/ অপমৃত্যু ঘটাবো)।” (সূরাহ্ আল্-হাক্ব্ক্বাহ্: ৪৪-৪৬)

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)কে ইচ্ছাকৃতভাবে কোরআনে বিকৃতিসাধনের কোনো সুযোগ দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে কোরআন নাযিলের উদ্দেশ্যই ভণ্ডুল হয়ে যেতো।

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পক্ষ থেকে অনিচ্ছাক্রমে বা ভুলক্রমেও কোরআন মজীদে কিছু হ্রাস-বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিলো না। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে মানুষের কাছে স্বীয় বাণী পৌঁছানোর পিছনে যে উদ্দেশ্য নিহিত তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ ধরনের ভ্রান্তি থেকে নবীকে রক্ষা করা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলারই দায়িত্ব এবং এ কাজ তাঁর জন্য খুবই সহজ।

কোরআন মজীদের যে কোনো সূরাহ্ বা আয়াত নাযিল্ হওয়ার সাথে সাথে তা নির্ভুলভাবে স্মরণে রাখার জন্য হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) খুবই যত্নবান ছিলেন এবং পাছে সামান্যও ভুল না হয় সে জন্য তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ কারণে তিনি তা মুখস্ত করার জন্য দ্রুত (এবং নিঃসন্দেহে বার বার) তা তেলাওয়াত্ করতেন। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা এ ব্যাপারে তাঁকে উদ্বিগ্ন হতে ও তাড়াহুড়া করতে নিষেধ করেন এবং জানিয়ে দেন যে, তিনি যাতে ভুলে না যান স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলাই তার নিশ্চিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এরশাদ হয়েছে:

“(হে রাসূল!) আপনি এটা (কোরআন ও তার আয়াত/ সূরাহ্ মুখস্ত করা) দ্রুতায়নের জন্য আপনার জিহবাকে সঞ্চালিত করবেন না। নিঃসন্দেহে এর (কোরআনের) একত্রিতকরণ (সংকলন ও গ্রন্থাবদ্ধকরণ) এবং এর পাঠ (সঠিকভাবে পাঠ করিয়ে দেয়া) আমারই দায়িত্ব। সুতরাং আমি যখন তা পাঠ করবো তখন আপনি তার সে পাঠের অনুসরণ করুন। অতঃপর এর বিস্তারিত বর্ণনার দায়িত্বও আমার।” (সূরাহ্ আল্-ক্বিয়ামাহ্: ১৬-১৯)

[নিঃসন্দেহে এখানে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে পাঠ করার মানে হচ্ছে বাতাসে কোনো ধরনের শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি না করে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর অন্তঃকরণে বা তাঁর কানের মধ্যে কোরআন মজীদ বা তার সূরাহ্/আয়াতের উচ্চারণ সৃষ্টি করা - যা তাঁর সামনে বসে থাকা অন্য লোকদের পক্ষে শুনতে পাওয়া সম্ভব ছিলো না।]

সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পক্ষ থেকে অনিচ্ছাক্রমে বা ভুলক্রমেও কোরআন মজীদে কিছু হ্রাস-বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিলো না।

কিন্তু কোরআন মজীদের নির্ভুলতার সপক্ষে বিচারবুদ্ধির সর্বজনীন অকাট্য দলীল এবং স্বয়ং কোরআন মজীদের অকাট্য দলীলের সাক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের দুই শতাধিক বছর পরে সংকলিত কতক হাদীছগ্রন্থে উল্লেখকৃত কোনো না কোনো স্তরে কম সূত্রে বর্ণিত কতক (খবরে ওয়াহেদ) হাদীছের ভিত্তিতে অনেকে মনে করেন যে, কোরআন মজীদে নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারণে কিছু কিছু রদবদল হয়ে থাকতে পারে।

কতক পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ জেনেবুঝে সত্য গোপন করার লক্ষ্যে এবং কতক মুসলমান ‘ইলমী যোগ্যতায় ঘাটতি ও ত্রুটির কারণে এ ধরনের সন্দেহকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। পশ্চিমা প্রাচ্যবিদগণ ভালোভাবেই জানেন যে, কোরআন মজীদকে কেউ বিকৃত করতে পারে নি। কারণ, মানবজাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত এ গ্রন্থের যেখানে সকল যুগে ও সকল দেশে একটিমাত্র সংস্করণ ছিলো এবং রয়েছে এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের দুই শতাধিক বছরেরও পরে সংকলিত হাদীছ গ্রন্থ সমূহে কোনো কোনো স্তরে কম সূত্রে বর্ণিত (খবরে ওয়াহেদ্) হাদীছের ভিত্তিতে এ গ্রন্থের ওপরে বিকৃতির সন্দেহ মোটেই বিবেচনাযোগ্য নয়, বরং বিচারবুদ্ধির রায়ে ঐ সব হাদীছ জাল হিসেবে পরিগণিত।

যা-ই হোক, এতদসত্ত্বেও কোরআন মজীদে বিকৃতি ঘটেছে বলে ধারণা প্রদানকারী কতক কল্পকাহিনী সম্পর্কে বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করলে তা থেকেও এগুলোর মিথ্যা হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কোনো কোনো খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছের ভিত্তিতে দাবী করা হয় যে, একবার শয়তান কোরআন মজীদের আয়াতের মধ্যে মুশরিকদের কল্পিত দেব-দেবী লাত্, মানাত্ ও ‘উযযা-র প্রশংসাসূচক দু’টি জাল আয়াত্ প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) বিষয়টি বুঝতে না পেরে তিনি তা তেলাওয়াত্ করেন, পরে প্রকৃত বিষয় জানতে পেরে তিনি তা কোরআন থেকে বাদ দেন।

এ ধরনের উদ্ভট কল্পকাহিনী কোরআন মজীদের পরিচয়ের সাথে পরিচিত সুস্থ বিচারবুদ্ধির অধিকারী কোনো মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। কারণ, আগেই যেমন উল্লেখ করেছি, কোরআন মজীদের মতো সর্বোচ্চ মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত গ্রন্থে খবরে ওয়াহেদ্ বর্ণনার ভিত্তিতে ত্রুটিনির্দেশ বা সংশয় পোষণ গ্রহণযোগ্য নয়; এ বিষয়ে এ ধরনের বর্ণনার কানাকড়ি মূল্য নেই, অন্যদিকে এটা কী করে সম্ভব হতে পারে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে (ছ্বাঃ) বিভ্রান্ত করার জন্য এভাবে শয়তানকে সুযোগ দেবেন?

এতদসত্ত্বেও যদি কেবল তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া হয় যে, এ ধরনের ঘটনা ঘটা সম্ভব, তাহলেও এ থেকে কোরআন মজীদের অবিকৃত থাকার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করার উপায় নেই। কারণ, উক্ত বর্ণনা অনুযায়ীও শয়তানের সৃষ্ট বিভ্রান্তি পরে সংশোধন করা হয়। অনুরূপভাবে যদি ধরে নেয়া হয় যে, নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর দ্বারা অনিচ্ছাক্রমে এতে কিছু ভুলত্রুটি প্রবেশ করে থাকতে পারে (যদিও এরূপ ভুলত্রুটি সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বিচারবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়) তাহলেও এটা নিঃসন্দেহ যে, এরূপ ভুলত্রুটি আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে সংশোধন করা হয়ে থাকবে।

তবে প্রকৃত ব্যাপার হলো নবী করীম (ছ্বাঃ) যখন কোরআন তেলাওয়াত্ করেছেন তখন স্মৃতি থেকে আমাদের তেলাওয়াতের মতো তাতে ভুল হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা ছিলো না। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলাই তাঁকে কোরআন পড়িয়ে দিতেন অর্থাৎ যখন কোরআন মজীদের কোনো অংশ নাযিল হতো এবং তিনি তা তেলাওয়াত করতে চাইতেন তখন স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলাই তাঁর কণ্ঠে তা জারী করে দিতেন। আল্লাহ্ তা‘আলা إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ - “নিঃসন্দেহে এর (কোরআনের) একত্রিতকরণ (সংকলন ও গ্রন্থাবদ্ধকরণ) এবং এর পাঠ (সঠিকভাবে পাঠ করিয়ে দেয়া) আমারই দায়িত্ব।” বলতে এটাই বুঝিয়েছেন।

অন্যদিকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় অন্য কোনো মানুষের পক্ষে কোরআন বিকৃত করার কোনো সুযোগই ছিলো না। বিশেষ করে এ ধরনের বিকৃতির কোনো দাবী বা এ মর্মে কোনো বর্ণনা নেই; এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে ইসলামের প্রথম যুগের ইসলাম-বিরোধীরা তা প্রচার করার সুযোগ হাতছাড়া করতো না। আসলে এ ধরনের অপচেষ্টার কথা ইসলামের কোনো দুশমনের মাথায় উদয় হলেও কার্যতঃ এরূপ অপচেষ্টা চালানো আদৌ সম্ভব ছিলো না। কারণ, কোথাও কোনো ব্যতিক্রমী আয়াত বা আয়াতাংশ বর্ণিত হলে, এমনকি একটি শব্দ এদিক-সেদিক করা হলেও তা যাচাই করার জন্য হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর কাছে পেশ করা হতো এবং তিনি তার মিথ্যা হওয়ার বিষয়টি ও কোরআন মজীদের সঠিক পাঠ সম্পর্কে জানিয়ে দিতেন। ফলে যে কেউই বিভ্রান্তি থেকে বেঁচে যেতো। অন্যদিকে ঐ ব্যক্তি তার এ মিথ্যাচারের জন্য সমাজের কাছে চিহ্নিত ও ধিক্কৃত হতো।

এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, কোরআন মজীদের ভাষার প্রাঞ্জলতা, তাৎপর্যের সূক্ষ্মতা, বাচনভঙ্গি, সাহিত্যিক মান, জ্ঞানগর্ভতা ও বক্তব্যের পারম্পর্য এমন যে, তার মধ্য থেকে কোনো কিছু বাদ দেয়া বা তাতে কিছু সংযোজন করা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিলো না বা নয়; কেউ তা করলে কোরআন মজীদের ভাষার সাথে পরিচিত যে কারো কাছেই তা ধরা পড়ে যেতো। এটা কোরআন মজীদের মু‘জিযাহর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, একটি গ্রন্থ হিসেবে কোরআন মজীদ একটি পূর্ণাঙ্গ একক (unit) - যার বক্তব্যের রয়েছে একটি সামগ্রিক আবেদন এবং একটি বৃক্ষের ন্যায়। এ সামগ্রিক আবেদনের রয়েছে বৃক্ষের কাণ্ডের সাথে তুলনীয় একটি কেন্দ্রীয় বক্তব্য এবং রয়েছে শাখা-প্রশাখার সাথে তুলনীয় সূরাহ্ সমূহ। ফলতঃ প্রতিটি সূরাহর যেমন কোরআন মজীদের অংশ হিসেবে সামগ্রিক এককের মধ্যে একটি অবস্থান রয়েছে, তেমনি একেকটি একক হিসেবে রয়েছে নিজস্ব সামগ্রিকতা।

বস্তুতঃ একটি বৃক্ষের কোনো শাখা-প্রশাখা কেটে ফেললে বা এর কাণ্ডের গায়ে বাইরের কোনো বৃক্ষ থেকে কেটে নিয়ে আসা শাখা-প্রশাখা বসিয়ে দিলে তা যে কোনো মানুষের পক্ষে সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব। একইভাবে বৃক্ষটির কোনো শাখা থেকে কোনো প্রশাখা কেটে ফেললে বা বাইরে থেকে আনা কোনো প্রশাখা এর কোনো শাখার গায়ে বসিয়ে দিলে তা-ও সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব। কোরআন মজীদের অবস্থাও তা-ই।

মোট কথা, কোরআন মজীদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই এতে কোনোরূপ সংযোজন-বিয়োজন সম্ভব ছিলো না। এরপরও হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় কেউ সে চেষ্টা করলে বিন্দুমাত্র সফল হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো না। কারণ, কোরআন পাঠ বা উদ্ধৃতকরণের ক্ষেত্রে কারো কাছ থেকে কোনো ব্যতিক্রমী কিছু গোচরে এলে ছ্বাহাবীগণ অবশ্যই তা রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর গোচরে আনতেন এবং এর ফলে বিকৃতিকারী ইসলামের দুশমন হিসেবে চিহ্নিত ও মুসলিম সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হতো। [আর অমুসলিমদের পক্ষ থেকে এ কাজ আদৌ সম্ভব ছিলো না। কারণ, কেউ কোরআন বা তার কোনো অংশই তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করতো না।]

বস্তুতঃ অবিকৃতভাবে কোরআন মজীদের সংকলন ও সংরক্ষণ ছিলো স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলার অকাট্য ফয়সালাসমূহের অন্যতম। আল্লাহ্ তা‘আলার ঘোষণা إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ - “নিঃসন্দেহে এর (কোরআনের) একত্রিতকরণ (সংকলন ও গ্রন্থাবদ্ধকরণ) এবং এর পাঠ (সঠিকভাবে পাঠ করিয়ে দেয়া) আমারই দায়িত্ব।” - থেকেই এটা সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, কোরআন মজীদের নির্ভুলভাবে সংকলিত ও গ্রন্থাবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি মানবিক কার্যকারণ বিধির ওপর নির্ভরশীল ছিলো না। অর্থাৎ এটা সম্ভব ছিলো না যে, ওয়াহী লিপিবদ্ধকারীরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এর লিপির কাজ বন্ধ করে দেবেন, বা যারা হাফেযে কোরআন ছিলেন তাঁরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা অন্যদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছানো থেকে বিরত থাকবেন। অর্থাৎ এটা এমন একটি বিষয় যা আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টি পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন ও চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত করার জন্য ঐ পরিকল্পনায়ই অনিবার্য করে রাখা হয়েছিলো।

ফলতঃ এ ছিলো এমন একটি বিষয় যে ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাহর কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেন। অর্থাৎ কেউ কোরআনকে বিকৃত করতে তথা এতে কম-বেশী করতে বা এর বিন্যাসে পরিবর্তন করতে চাইলে কিছুতেই আল্লাহ্ তা‘আলা তা করতে দিতেন না। এ বিষয়টি আল্লাহ্ তা‘আলা নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর উদ্দেশে যা বলেছেন - যা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে - তা থেকেই প্রমাণিত হয়। কারণ, তিনি নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর উদ্দেশে এরশাদ করেন:

“আর তিনি যদি আমার নামে (নিজ থেকে) কতক কথা বলেন তাহলে অবশ্যই আমি তাঁর ডান হাত ধরে ফেলবো (তাঁকে পাকড়াও করবো), এরপর অবশ্যই তাঁর গর্দান কেটে ফেলবো (ঘাড় মটকে দেবো/ অপমৃত্যু ঘটাবো)।” (সূরাহ্ আল্-হাক্ব্ক্বাহ্: ৪৪-৪৬)

সুতরাং এটা সন্দেহাতীত যে, আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় বা তাঁর ইন্তেকালের পরে কোনো অবস্থায়ই কাউকে কোরআন মজীদে বিকৃতিসাধনের সুযোগ দিতেন না, বরং কেউ চেষ্টা করলে তাকে ধ্বংস করে দিতেন। অবশ্য কোনো অমুসলিমের পক্ষ থেকে এ ধরনের অপচেষ্টা চললে সে ক্ষেত্রে তাকে ঐশী হস্তক্ষেপের দ্বারা প্রতিহত করা অপরিহার্য ছিলো না। কারণ, কোনো অমুসলিম এ ধরনের বিকৃতিসাধন করে একটি বিকৃত কোরআন হাযির করলে তা মুসলমানদের কাছে তো নয়ই কোনো অমুসলিমের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতো না। ফলে কোরআন মজীদ সম্পর্কে কারো মনেই সন্দেহ সৃষ্টি হতো না। কারণ, কোনো গ্রন্থে বিকৃতি কেবল তখনই প্রমাণিত হয় যখন অবিকৃত গ্রন্থটি আদৌ পাওয়া যাচ্ছে না বলে সর্বজনীন বিচারবুদ্ধি স্বীকার করে, অথবা যখন কোনো গ্রন্থের ধারক-বাহকদের পক্ষ থেকে সঠিক বলে একই গ্রন্থের দু’টি সংস্করণ হাযির করা হয় এবং উভয় গ্রন্থের সূত্রের মধ্যে অগ্রাধিকার নির্ণয় করা সম্ভব না হয়, অথচ দুই গ্রন্থের বক্তব্যে কিছু পার্থক্য থাকে। আর বলা বাহুল্য যে, সকল যুগে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছে কোরআন মজীদের অভিন্ন সংস্করণ ছিলো এবং রয়েছে।

তবে আমরা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলার সিদ্ধান্ত ও হস্তক্ষেপের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে কেবল সর্বজনীন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি বিচার করি - যা অমুসলিমদের কাছেও গ্রহণযোগ্য - তাহলে দেখতে পাই যে, কোরআন মজীদ স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধকরণ ও সুবিন্যস্তকরণের এবং মুখস্তকরণের মাধ্যমে এমনভাবে সংকলিত, সুবিন্যস্ত ও সংরক্ষিত হয় যে, এতে কোনোরূপ ত্রুটি প্রবেশ করানোর ক্ষমতা কারোই ছিলো না। তেমনি তাঁর ইন্তেকালের পরেও এর লিখিত কপিকরণের কাজ এমন ব্যাপকতা লাভ করে এবং এর মুখস্তকারীদের সংখ্যা অনবরত এমনভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে যে, এতে হ্রাস-বৃদ্ধি বা এর বিন্যাসে পরিবর্তন সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা কোনো সুস্থ বিচারবুদ্ধির অধিকারী মানুষের মাথায়ই আসতে পারে না।

আল্লাহ্ তা‘আলা এ বিষয়টিও কোরআন মজীদে এভাবে ঘোষণা করেছেন:

“আর নিঃসন্দেহে এ হচ্ছে সেই অকাট্য গ্রন্থ - যাতে না পূর্ব থেকে কোনো মিথ্যা প্রবেশ করেছে, না পরে (তাতে কোনো মিথ্যা প্রবেশ করা সম্ভব)। (কারণ,) এ হচ্ছে চিরপ্রশংসিত চিরপরমজ্ঞানী (আল্লাহ্ তা‘আলা) থেকে নাযিলকৃত।” (সূরাহ্ হা-মীম্-আস্-সাজদাহ্/ ফুছ্বছ্বিলাত্: ৪১-৪২)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

বায়তুল্লাহ জিয়ারত ও হজ
প্রকৃত রোজা ও সংযমের কিছু ...
গীবত ও চুগলখোরীর ভয়াবহ পরিণাম
সফরে কসর ওয়াজিব
হজ্বঃ মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ ...
হজ্ব: বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সোপ
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক
হাজিদের উদ্দেশ্যে ইরানের ...
মিরাজুন্নবীর (সা.) তাৎপর্য ও ...
দাসত্ব-উবুদিয়্যাহ

 
user comment