সূরা আত তাওবা; আয়াত ৭-১১
সূরা তাওবার ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
كَيْفَ يَكُونُ لِلْمُشْرِكِينَ عَهْدٌ عِنْدَ اللَّهِ وَعِنْدَ رَسُولِهِ إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ عِنْدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ فَمَا اسْتَقَامُوا لَكُمْ فَاسْتَقِيمُوا لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ
“আল্লাহ ও তার রাসূলের নিকট মুশরিক বা অংশীবাদীদের চুক্তি কি করে বলবত থাকবে? তবে যাদের সঙ্গে মসজিদুল হারামের সন্নিকটে তোমরা পারস্পরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলে তারা যতদিন চুক্তিতে স্থির থাকবে তোমরাও তাদের সঙ্গে চুক্তিতে স্থির থাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তকী বা পরহেজগারদের ভালোবাসেন।”(৯:৭)
এই সূরার প্রথম আয়াতেই মুশরিক বা অংশীবাদীদের প্রতি আল্লাহ ও তার রাসূলের অসন্তুষ্টি এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, মুসলমানরা যেসব মুশরিকের সঙ্গে মাসজিদুল হারাম বা কাবা শরীফের কাছে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, তারা যদি চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় তাহলে মুসলমানরাও তা মেনে চলতে বাধ্য।
আর মুশরিকরা যদি চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয় তাহলে একতরফাভাবে মুসলমানরা তা মেনে চলতে বাধ্য নয়। তবে মুশরিক বা শত্রুদের সাথে আচরণের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে তাকওয়া বা খোদাভীতি বিবেচনায় রাখতে হবে, কোনো অবস্থায়ই ন্যায় ও ইনসাফের সীমা লংঘন করা যাবে না।
এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে এই শিক্ষাই দেয়া হয়েছে যে, সামাজিক চুক্তি বা অঙ্গীকারের উপর স্থির থাকা এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ঈমান ও তাকওয়া অর্জনের জন্য জরুরী। তবে, চুক্তি মানা-না মানার বিষয়টি নির্ভর করবে প্রতিপক্ষের আচরণের উপর। প্রতিপক্ষ চুক্তি মেনে চললে মুসলমানরাও তা মেনে চলতে বাধ্য।
এ সূরার ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
كَيْفَ وَإِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ لَا يَرْقُبُوا فِيكُمْ إِلًّا وَلَا ذِمَّةً يُرْضُونَكُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ وَتَأْبَى قُلُوبُهُمْ وَأَكْثَرُهُمْ فَاسِقُونَ
“কিভাবে (মুশরিকদের সাথে চুক্তি ধরে রাখা) সম্ভব? তারা যদি তোমাদের ওপর জয়ী হয় তবে তারা তোমাদের আত্মীয়তার ও অঙ্গীকারের কোনো মর্যাদা দেবে না। তারা মুখে তোমাদেরকে সন্তুষ্ট রাখে কিন্তু তাদের হৃদয় তা অস্বীকার করে। বস্তুত: তাদের অধিকাংশই সত্যত্যাগী ফাসেক।” (৯:৮)
এই আয়াতে মুসলমানদেরকে শত্রুর মিষ্টি কথায় প্রতারিত না হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। মুসলমানদের শত্রুপক্ষের আসল চরিত্র ও মনোভাব এই পবিত্র আয়াতে প্রতিভাত হয়েছে। এখানে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, মুমিন মুসলমানদের ব্যাপারে অবিশ্বাসী মুশরিকদের মন কখনোই পরিস্কার ও স্বচ্ছ হবে না। তাদের মনে মুসলমানদের ব্যাপারে সব সময়ই এক ধরনের হিংসা ও বিদ্বেষ কাজ করে। এটা বাস্তবে তখনই বুঝা যায় যখন তারা ক্ষমতা লাভ করে এবং মুসলমানদের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তখন দেখা যায় তারা কোনো আইন বা নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করে না। এমনকি অত্যন্ত নিকট আত্মীয় মুসলমানের প্রতিও সামান্য দয়া প্রদর্শন করে না। প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি তখন তাদের কাছে সম্পূর্ণ মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
এই আয়াত থেকে এই শিক্ষাই নিতে হবে যে, কে শত্রু তা ভালো করে চিনতে হবে। কারণ শত্রু মুখে মিষ্টি কথা বললেও অন্তর থেকে তারা কখনও মুমিনদেরকে গ্রহণ করতে পারে না এবং মুমিনদের উপকার হবে এমন কাজও তারা করে না।
এই সূরার ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
اشْتَرَوْا بِآَيَاتِ اللَّهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِهِ إِنَّهُمْ سَاءَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“তারা আল্লাহর আয়াতকে নগণ্য মূল্যে বিক্রি করেছে ও তারা লোকদেরকে তার পথ থেকে নিবৃত্ত করেছে, নিশ্চয়ই তারা যা করেছে তা অতি জঘন্য।” (৯:৯)
ইসলামের শত্রুদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে যা আগে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলোর চেয়ে ভিন্ন আঙ্গিকের। এখানে বলা হচ্ছে, তারা ইসলামের প্রসার ঠেকানোর জন্য কোনো প্রচেষ্টাই বাদ দেয় না। এমনকি এ কাজের পেছনে তারা বিপুল পরিমাণে অর্থ খরচ করতেও পিছপা হয় না। বিশেষ করে মদীনা শরীফে বসবাসকারী ইহুদীরা এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। তাদের কাছে ঐশি গ্রন্থ তওরাত ছিল এবং তারা ঐশি বাণী সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত ছিল। তারপরও তারা বৈষয়িক স্বার্থে সত্য গোপন করেছে এবং ইসলামের প্রসার প্রতিহত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে।
আল্লাহর দেয়া বিধান পরিত্যাগ করে যারা বৈষয়িক স্বার্থের পেছনে দৌঁড়ায় তারা হয়তো মনে করে অনেক লাভবান হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে বাহ্যত তাদের এই প্রাপ্তি অনেক বেশি মনে হলেও তা খুবই নগণ্য।
এই আয়াত থেকে বুঝা যায়, বৈষয়িক স্বার্থই ইসলামের সাথে শত্রুতার মূল কারণ। এ ছাড়া ইসলামের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করার অন্য কোনো কারণ নেই।
এই সূরার ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لَا يَرْقُبُونَ فِي مُؤْمِنٍ إِلًّا وَلَا ذِمَّةً وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُعْتَدُونَ (10) فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَنُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
“মুশরিকরা কোনো মুমিন বিশ্বাসীর সাথে আত্মিয়তার ও অঙ্গীকারের মর্যাদা রক্ষা করে না। তারাই সীমালঙ্ঘনকারী।” (৯:১০)
“অতঃপর তারা যদি তাওবা করে যথাযথ নামাজ পড়ে ও যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের ধর্ম ভাই এবং জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আমি নিদর্শনসমূহ স্পষ্টরূপে বিবৃত করি।” (৯:১১)
এই আয়াতে মুমিন মুসলমানদের সাথে অবিশ্বাসী কাফেরদের সহিংস আচরণের বিষয়টি আবারো উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, মুশরিকরা প্রকৃতপক্ষে সীমালংঘনকারী। তারা যেমন সামাজিক চুক্তি লংঘন করে তেমনি অবলীলায় তারা মানবিক অধিকারও উপেক্ষা করতে পারে। তবে ইসলাম তাদের সংশোধনের পথ বন্ধ করে দেয়নি। তারা যদি মুর্তিপূজা এবং শিরক্ পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে নামাজ পড়ে এবং যাকাত দেয় তাহলে তারাও মুমিনদের ধর্মভাই হিসেবে গণ্য হবেন এবং তাদের সঙ্গে উপযুক্ত আচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই আয়াতে নামাজ ও যাকাতকে ধর্মীয় বন্ধনের ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।