আমাদের ইমামগণ ঐশী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, ফলে যে কোন প্রশ্নই তাদেরকে করা হতো তার সঠিক, পূর্ণ ও প্রশ্নকারীর বোধগম্যতার আলোকে জবাব দিতেন । যে কেউ এমন কি শত্রুরাও যদি ইমামগণের সাথে জ্ঞানগর্ভ ও তত্ত্বীয় আলোচনায় বসত, স্বীয় অক্ষমতাকে স্বীকার করার পাশাপাশি তাঁদের বিস্তৃত চিন্তা শক্তি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর পূর্ণ দখলের কথা অকপটে স্বীকার করত ।
হারুনুর রশিদ ইমাম কাযেম (আ.)-কে মদীনা থেকে বাগদাদ নিয়ে আসল এবং তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলো । হারুন : অনেকদিন যাবৎ ভাবছি আপনার কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করব, যা আমার মনে জেগেছে । আজোবধি কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি । আমাকে বলা হয়েছে যে, আপনি কখনোই মিথ্যা বলেন না । আমার প্রশ্নের সঠিক ও সত্য জবাব প্রদান করুন!
ইমাম : যদি আমাকে বাক স্বাধীনতা দাও, তবে তোমার প্রশ্ন সম্পর্কে আমি যা জানি, তা তোমাকে অবহিত করব ।
হারুন : আপনি স্বাধীন । আপনার যা বলার মুক্তভাবে ব্যক্ত করতে পারেন... ।
যাহোক আমার প্রথম প্রশ্ন হলো : কেন আপনি এবং জনগণ বিশ্বাস করেন যে, আপনারা আবু তালিবের সন্তানরা, আমরা আব্বাসের সন্তানদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব রাখেন । অথচ আমরা এবং আপনারা একই বৃক্ষের অংশ ।
আবু তালিব ও আব্বাস উভয়েই মহানবী (সা.)-এর চাচা ছিলেন এবং আত্মীয়তার দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ।
ইমাম : আমরা তোমাদের চেয়ে মহানবী (সা.)-এর বেশী নিকটবর্তী ।
হারুন : কিরূপে?
ইমাম : যেহেতু আমাদের পিতা আবু তালিব ও মহানবী (সা.)-এর পিতা পরস্পর আপন ভাই (পিতা ও মাতা একই) ছিলেন কিন্তু আব্বাস আপন ভাই ছিলেন না (কেবলমাত্র মাতৃকূল থেকে) ।
হারুন : অন্য প্রশ্ন : কেন আপনারা দাবী করেন যে, আপনারা মহানবী (সা.) থেকে উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হবেন, অথচ আমরা জানি যে, যখন নবী (সা.) পরলোক গমন করেছেন, তখন তার চাচা আব্বাস (আমাদের পিতা) জীবিত ছিলেন । কিন্তু অপর চাচা আবু তালিব (আপনাদের পিতা) জীবিত ছিলেন না । আর এটা সকলের জানা যে, যতক্ষণ পর্যন্ত চাচা জীবিত আছেন, চাচার সন্তানের নিকট উত্তরাধিকার পৌঁছে না ।
ইমাম : আমি স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারি তো? হারুন : আলোচনার শুরুতেই আমি বলেছি, মতামত ব্যক্ত করার ব্যাপারে আপনি স্বাধীন ।
ইমাম : ইমাম আলী (আ.) বলেন : সন্তানের উপস্থিতিতে, পিতা, মাতা ও স্বামী, স্ত্রী ব্যতীত কেউ উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হবে না । আর সন্তান থাকলে চাচার উত্তরাধিকার লাভের ব্যাপারটি কোরআনে কিংবা রেওয়ায়েতে প্রমাণিত হয়নি । অতএব, যারা চাচাকে পিতার নিয়মের অন্তর্ভূক্ত করে, নিজ থেকেই বলে এবং তাদের কথার কোন ভিত্তি নেই । (অতএব, নবীকন্যা যাহরা (আ.)-এর উপস্থিতিতে তাঁর চাচা আব্বাসের নিকট উত্তরাধিকার পৌঁছে না) ।
তাছাড়া আলী (আ.)-এর সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,
اقضاكم علىّ
আলী তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট বিচারক । ওমর ইবনে খাত্তাব থেকেও বর্ণিত হয়েছে :
علىّ اقضانا
আলী আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক : এ বাক্যটি হলো সামগ্রিক তাৎপর্যবহ যা হযরত আলীর জন্য প্রমাণিত হয়েছে । কারণ, সকল প্রকারের বিদ্যা যেগুলোর মাধ্যমে স্বীয় সাহাবীগণকে প্রশংসা করেছেন যেমন : কোরআনের জ্ঞান, আহকামের জ্ঞানও সর্ব বিষয়ে জ্ঞান ইত্যাদি সবকিছুই ইসলামী বিচারের তাৎপর্যে নিহিত রয়েছে । যখন বলা হবে আলী (আ.) বিচারকার্যে সকলের চেয়ে উৎকৃষ্ট, তবে তার অর্থ হবে, তিনি সর্বপ্রকার জ্ঞানেই সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ।
(অতএব, ইমাম আলীর এ উক্তি যে, সন্তানের বর্তমানে চাচা উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হবে না তা চূড়ান্ত দলিল রূপে পরিগণিত হবে । সুতরাং একে গ্রহণ করা উচিৎ, না কি যে মত বলে : চাচা আইনগত ভাবে পিতার স্থানে । কারণ, নবী (সা.)-এর বক্তব্য অনুসারে, আলী (আ.) দীনের আহকাম সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বেশি জ্ঞাত) ।
হারুন : অপর প্রশ্ন ।
কেন আপনারা মানুষকে অনুমতি দেন আপনাদেরকে রাসূল (সা.)-এর সাথে সম্পর্কিত করতে এবং এ কথা বলতে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর সন্তান । অথচ আপনারা হলেন আলীর সন্তান । কারণ, প্রত্যেককেই তার পিতার সাথে সম্পর্কিত করা হয় (মাতার সাথে নয়) । আর মহানবী (সা.) হলেন আপনাদের নানা ।
ইমাম : যদি মহানবী (সা.) জীবিত হয়ে তোমার কন্যাকে বিয়ে করতে চান, তবে তুমি কি তোমার কন্যাকে তাঁর সাথে বিয়ে দিবে?
হারুন : সুবহানাল্লাহ, কেন দেব না । বরং ঐ অবস্থায় আরব, অনারব এবং কোরাইশদের সকলের উপর গর্ববোধ করব । ইমাম : কিন্তু নবী (সা.) জীবিত হলে আমার কন্যার জন্য প্রস্তাব দিবেন না, কিংবা আমিও দিব না ।
হারুন : কেন?
ইমাম : কারণ, তিনি আমার পিতা (যদিও মাতৃদিক থেকে ) কিন্তু তোমার পিতা নন । (অতএব, নিজেকে আল্লাহর রাসূলের সন্তান বলে মনে করতে পারি) ।
হারুন : তাহলে কেন আপনারা নিজেদেরকে রাসূলের বংশধর বলে মনে করেন । অথচ বংশ পিতৃকুল থেকে নির্ধারিত হয়, মাতৃকুল থেকে নয় ।
ইমাম : আমাকে এ প্রশ্নের জবাব প্রদান থেকে অব্যাহতি দাও ।
হারুন : না, আপনাকে জবাব দিতে হবে; আর সেই সাথে কোরআন থেকে দলিল বর্ণনা করুন.. ।
ইমাম :
ومن ذرّيّته داود وسليمان و وايّوب ويوسف و مو سي وهارون وكذلك نجزي المحسنين و زكريّا و يحيي و عيسي
তাহার(ইবরাহীম) বংশধর দাউদ, সুলায়মান, আইয়ুব, ইউসুফ, মূসা ও হারুনকেও, আর এভাবে সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি এবং যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা .. ।
এখন তোমাকে প্রশ্ন করব : এ আয়াতে যে, ঈসা (আ.) ইবারহীম (আ.)-এর বংশ বলে পরিগণিত হয়েছে, তা কি পিতৃকুল থেকে, না মাতৃকুল থেকে?
হারুন : কোরআনের দলিল মোতাবেক ঈসা (আ.)-এর কোন পিতা ছিলেন না ।
ইমাম : তাহলে মাতৃকুল থেকেই বংশধর বলে পরিগণিত হয়েছে । আমরাও আমাদের মাতা ফাতেমার (আল্লাহ তাঁর উপর শান্তি বর্ষণ করুন) দিক থেকে রাসূলের বংশধর বলে পরিগণিত হই ।
অন্য একটি আয়াত পড়ব কি?
হারুন : পড়ুন!
ইমাম : মোবাহেলার আয়াতটি পড়ব :
فمن حاجّك فيه من بعد ماجائك من العلم فقل تعالوا ندع ابنائنا و ابنئكم و نسائنا و نسائكم و انفسنا وانفسكم ثمّ نبتهل فنجعل لعنة الله علي الكاذبين
“তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে তোমার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়, তাকে বল; আস, আমরা আহবান করি আমাদের পুত্রগণকে ও তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারিগণকে ও তোমাদের নারিগণকে, আমাদের নিজ দিগকে ও তোমাদের নিজদিগকে; অতঃপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহর লা’নত ।”
কেউই এরূপ দাবী করেনি যে, মহানবী (সা.) নাজরানের নাসারাদের সাথে মোবাহেলা করার জন্য আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন ব্যতীত অন্য কাউকে নিজের সঙ্গী করেছেন । অতএব, উল্লিখিত আয়াতে আব না’য়ানার (আমাদের পুত্রগণ) দৃষ্টান্ত হলেন ইমাম হাসান (আ.) ও হোসাইন (আ.), যদি ও তারা মাতৃ দিক থেকে রাসূলের সাথে সম্পর্কিত এবং তাঁর কন্যার সন্তান ।
হারুন : আমার নিকট কিছু চাইবেন কি?
ইমাম : না, আমার নিজের গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে চাই ।
হারুন : এ বিষয়ে চিন্তা করে দেখব ... । (উয়ুনু আখবারুর রেযা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮১, ইহতিজাজে তাবারসী, পৃ. ২১১-২১৩, বিহারুল আনওয়ার, ৪৮তম খণ্ড, পৃ. ১২৫-১২৯। )