ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ (রুকন) হচ্ছে রমযান মাসের রোযা। রোযা বাধ্যতামূলক (ফরয)১ এব্যাপারে কোন বিতর্ক নেই। কেউ রমযান মাসের রোযা ফরয হবার বিষয়টি অস্বীকার করলে সে ইসলামের সীমারেখা থেকে বেরিয়ে যাবে। কারণ রোযা নামাযের মতই ফরয এবং এ ব্যাপারে শিক্ষিত-অশিক্ষিত,ধনী-গরীব,ছোট-বড় সকলের অবস্থান অভিন্ন।
হিজরতের দ্বিতীয় বছরে রমযানের রোযা ফরয করা হয়। যে কোন মুকাল্লাফ (অর্থাৎ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি)-এর জন্য,যার জন্য দীনী দায়িত্ব কর্তব্য পালন অপরিহার্য,তার জন্য রমযানের রোযা রাখা বাধ্যতামূলক এবং নিম্নলিখিত কোন কারণ ব্যতীত রোযা না রাখার বা ভঙ্গ করার অনুমতি নেই :
১. হায়েয ও নেফাস : ইসলামের সকল মাজহাব এ ব্যাপারে একমত,নারীদের জন্য তাদের মাসিক ঋতুস্রাব (হায়েয) কালে ও সন্তান জন্মদান-পরবর্তী রক্তপাত (নিফাস) অব্যাহত থাকাকালে রোযা রাখা জায়েয নয়।
২. অসুস্থতা : এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইসনা আশারীয়া বা ইমামী শিয়া মাজহাবের মতে রোযা রাখলে কোন ব্যক্তি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে বা রোগ বৃদ্ধি পায় অথবা ব্যথা বাড়ে বা আরোগ্য লাভ পিছিয়ে যায় তাহলে তার জন্য ঐ অবস্থায় রোযা রাখা জায়েয নেই। কারণ অসুস্থতা বা রোগ ব্যক্তির ক্ষতি করে এবং ক্ষতি সাধন বা ক্ষতি ডেকে আনা হারাম।এ ছাড়া ইবাদতের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে এমন বিষয় যে,অতঃপর ঐ কাজটি সম্পাদন করা হলে তা আর ইবাদত বলে গণ্য হয় না। অতএব,এরূপ অবস্থায় যদি কোন ব্যক্তি রোযা রাখে তাহলে তার রোযা সহীহ হবে না। তাই রোযা রাখলে অসুস্থ হয়ে পড়ার বা অসুস্থতা বৃদ্ধির প্রবল আশংকা থাকলে রোযা না রাখার কারণ হিসেবে তাই যথেষ্ট। অবশ্য কেউ যদি রোযা রাখার কারণে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে,কিন্তু তা সত্ত্বেও তা সহ্য করা সম্ভব হয়,তাহলে যতক্ষণ তা সহ্য করা সম্ভব হবে ততক্ষণ পর্যন্ত রোযা ভঙ্গ করা জায়েয নেই। কারণ রোযা না রাখার কারণ হচ্ছে অসুস্থতা- দুর্বলতা,শরীর কৃশ হওয়া বা কষ্ট অনুভূত হওয়া এর কারণ নয়;কারণ যে কোন কর্তব্য পালনেই কষ্ট থাকে।
এ ক্ষেত্রে চার সুন্নী মাজহাবের মত হচ্ছে রোযাদার ব্যক্তি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে বা তার রোগবৃদ্ধি বা আরোগ্য লাভ পিছিয়ে যাবার আশংকা করে তাহলে সে চাইলে রোযা রাখতে পারে বা চাইলে রোযা নাও রাখতে পারে। তার জন্য রোযা না রাখা বা ভঙ্গ করা বাধ্যতামূলক নয়। এঅবস্থায় তাকে অবকাশ দেয়া হয়েছে,কিন্তু রোযা না রাখা বা ভঙ্গ করাকে বাধ্যতামূলক করা হয় নি। কিন্তু যে ক্ষেত্রে মৃত্যু অথবা অঙ্গহানি বা কোন ইন্দ্রিয় বিনষ্ট হবার আশংকা থাকে সে ক্ষেত্রে ব্যক্তির জন্য রোযা না রাখা বা ভঙ্গ করা বাধ্যতামূলক এবং এরূপ অবস্থায় রোযা রাখলে তা সহীহ হবে না।
৩. মায়ের গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে ও সন্তানকে দুগ্ধ দান কালে : এ প্রসঙ্গে আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মত হচ্ছে,গর্ভবতী বা সন্তানকে দুগ্ধ দানকারিণী যদি আশংকা করে,রোযা রাখলে তার নিজের ও সন্তানের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে তা সত্ত্বেও সে রোযা রাখলে তার রোযা সহীহ হবে যদিও এ অবস্থায় রোযা রাখা হতে বিরত থাকার অনুমতি রয়েছে। এ অবস্থায় সে যদি রোযা না রাখে তাহলে তাকে পরে এসব রোযার ক্বাযা আদায় করতে হবে। এ ব্যাপারে চার মাজহাব অভিন্ন মত পোষণ করে। কিন্তু একই সাথে রোযা না রাখা বা ভাঙ্গার জন্য ফিদইয়াহ্ বা কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে কিনা সে প্রশ্নে মাজহাব চতুষ্টয়ের মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছে। এ ব্যাপারে হানাফী মাজহাবের মত হচ্ছে,এটি আদৌ ওয়াজিব নয়। কিন্তু মালিকী মাজহাবের মতে এটি দুগ্ধ দানকারিণী মায়ের জন্য ওয়াজিব,তবে গর্ভবতী মায়ের জন্য ওয়াজিব নয়।
এ ব্যাপারে হাম্বলী ও শাফেয়ী মাজহাবের মত হচ্ছে,গর্ভবতী বা দুগ্ধ দানকারিণী নারী যদি শুধু সন্তানের ব্যাপারে আশংকা করে তাহলে তার জন্য ফিদইয়াহ্ প্রদান করা ওয়াজিব হবে। কিন্তু সে যদি নিজ ও সন্তান উভয়ের ব্যাপারে আশংকা করে তাহলে তাকে শুধু ক্বাযা আদায় করতে হবে,ফিদইয়াহ্ দিতে হবে না। প্রতিদিনের জন্যে ফিদইয়াহ্ হচ্ছে এক মুদ্দ২- যা একজন মিসকিনকে খাওয়ানোর পরিমাণ বলে নির্ধারিত।
ইমামী মাজহাবের মতে সন্তানের জন্মদান নিকটবর্তী এমন গর্ভবতী মা ও সন্তানকে দুগ্ধ দান করছেন এমন মা- উভয়ের ক্ষেত্রে ক্ষতির আশংকা থাকলে রোযা রাখা হতে বিরত থাকা অপরিহার্য এবং তাদের রোযা সহীহ হবে না। কারণ ক্ষতি হতে দেয়া নাজায়েয। এ ব্যাপারে ইমামী ফকীহ্গণ একমত,তাদের উভয়কেই রোযা ক্বাযা করতে হবে এবং শুধু সন্তানের ক্ষতির আশংকা থাকলে সেই সাথে মুদ্দ পরিমাণ ফিদইয়াহ্ দিতে হবে। কিন্তু শুধু মায়ের ক্ষতির আশংকা থাকলে কতক ফকীহর মতে শুধু ক্বাযা করতে হবে,ফিদইয়াহ্ দিতে হবে না। অন্যদের মতে ক্বাযাও করতে হবে,ফিদইয়াহ্ও দিতে হবে।
৪. সফর অর্থাৎ প্রতিটি মাজহাবের মত অনুযায়ী যে সফরে নামায কসর করার শর্তাবলীরয়েছে :
আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মতে রোযা ক্বাযা করার জন্য সফরের শর্তাবলী ছাড়াও আরো একটি শর্ত রয়েছে,তা হচ্ছে সুবহে সাদেকের পূর্বে সফর শুরু হতে হবে এবং যেখানে পৌঁছলে নামায কসর হবে সেখানে সুবহে সাদেকের পূর্বে পৌঁছতে হবে। আর সে যদি সুবহে সাদেক শুরু হবার পরে সফর শুরু করে তাহলে তার জন্য রোযা ভঙ্গ করা হারাম। আর যদি সে ভেঙ্গেই ফেলে তাহলে তাকে ক্বাযা আদায় করতে হবে,তবে কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে না। এ ক্ষেত্রে শাফেয়ী মাজহাবে আরেকটি শর্ত যোগ করা হয়েছে। তা হচ্ছে,যে ব্যক্তি সাধারণত সব সময় সফরের মধ্যে থাকে,যেমন একজন ড্রাইভার,তার ক্ষেত্রে উপরোক্ত মত প্রযোজ্য হবে না। অতএব,যে ব্যক্তি সাধারণত সফরের মধ্যে থাকে সে রোযা ভঙ্গ করতে পারবে না।
আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মতেই সফরে রোযা না রাখা ঐচ্ছিক ব্যাপার,বাধ্যতামূলক নয়। অতএব,যে মুসাফিরের জন্য রোযা না রাখার সকল শর্তই বিদ্যমান রয়েছে সে চাইলে রোযা রাখতে পারবে,চাইলে না রাখতে বা ভঙ্গ করতে পারবে। হানাফী মাজহাবের মতে সফরে নামায কসর করা বাধ্যতামূলক,ঐচ্ছিক নয়। তবে রোযা ভঙ্গ করা অথবা না করা ঐচ্ছিক ব্যাপার।
এ ব্যাপারে ইমামীদের মত হচ্ছে মুসাফিরের জন্য নামায কসর করার শর্তাবলী পূর্ণ হয়ে থাকলে সে রোযা রাখলে তা কবুল হবে না। অতএব,সে যদি রোযা রাখে তথাপি তাকে ক্বাযা করতে হবে,তবে কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে না। এটি মধ্য দুপুর (যোহর)-এর পূর্বে সফরে বহির্গত ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু সে যদি মধ্য দুপুরে বা তারপরে সফরে বের হয় তাহলে তাকে রোযা রাখতে হবে। আর সে যদি রোযা ভেঙ্গে ফেলে তাহলে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে রোযা ভঙ্গকারীর জন্যে নির্ধারিত কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে। আর মুসাফির যদি মধ্য দুপুরের পূর্বেই নিজ শহর বা যেখানে দশদিন থাকবে বলে নিয়্যত করেছে সেখানে পৌঁছে যায় এবং তার পূর্বে রোযা ভঙ্গকারী কোন কাজ না করে থাকে তাহলে তার রোযা পূর্ণ করা অপরিহার্য। এমতাবস্থায় যদি সে রোযা ভঙ্গ করে তাহলে তার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে রোযা ভঙ্গকারীর হুকুম কার্যকর হবে।
৫. ক্ষুধা ও তৃষ্ণা : এ ব্যাপারে পাঁচ মাজহাব মতৈক্য পোষণ করে,কেউ যদি বেশি পিপাসার্ত হয়ে পড়ার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সে রোযা ভঙ্গ করতে পারবে। আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মতে পরবর্তী সময়ে যদি তার পক্ষে ক্বাযা করা সম্ভব হয় তাহলে তাকে ক্বাযা করতে হবে,তবে কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে না। কিন্তু ইমামী মতে তাকে এক মুদ্দ পরিমাণ কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে। বেশি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লে পিপাসার ন্যায় তা রোযা ভঙ্গ করার বৈধতার কারণরূপে গণ্য হবে কিনা এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মতে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা একই রকম এবং উভয় ক্ষেত্রেই রোযা ভঙ্গ করা জায়েয। কিন্তু ইমামীদের মতে ক্ষুধার কারণে রোযা ভঙ্গ করা জায়েয নয় যদি না এর ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ার আশংকা থাকে।
৬. বার্ধক্য : যে সব বৃদ্ধ নারী-পুরুষের পক্ষে রোযা রাখা ক্ষতিকর ও কঠিন,তারা রোযা রাখা থেকে বিরত থাকতে পারবে;কিন্তু তাদেরকে ফিদইয়াহ্ দিতে হবে। বাদ দেয়া প্রতিটি রোযার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে খাওয়াতে হবে। তেমনি যে অসুস্থ ব্যক্তির পুরো বছরের মধ্যে সুস্থ হবার সম্ভাবনা নেই তার জন্যও এ হুকুমই প্রযোজ্য। হাম্বলী ছাড়া বাকী চার মাজহাব এ ব্যাপারেএকমত। কিন্তু হাম্বলী মাজহাবের মত হচ্ছে এরূপ ব্যক্তির জন্য ফিদইয়াহ্ প্রদান করা মুস্তাহাব মাত্র,অপরিহার্য নয়।
৭. অজ্ঞান হওয়া : বেহুশ ব্যক্তির জন্য রোযা অপরিহার্য নয়,এমন কি দিনের অংশ বিশেষের জন্য বেহুশ হয়ে থাকলেও। তবে কেউ যদি বেহুশ হবার পূর্বেই রোযার নিয়্যত করে থাকে এবং বেহুশ হবার পরপরই তার সংজ্ঞা ফিরে আসে তাহলে তাকে রোযা অব্যাহত রাখতে হবে।
রোযা না রাখার কারণের বিলুপ্তি
যে সব কারণে রোযা না রাখা বা ভঙ্গ করা জায়েয তার বিলুপ্তি ঘটলে,যেমন অসুস্থ ব্যক্তি আরোগ্য লাভ করলে,নাবালেগ বালেগ হলে,মুসাফির বাড়ী ফিরে এলে বা নারীর ঋতুস্রাব বন্ধ হলে ইমামী ও শাফেয়ীদের মতে রোযার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য রোযা ভঙ্গকারী কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব;হানাফী ও হাম্বলীদের মতে ওয়াজিব কিন্তু মালিকীদের মতে মুস্তাহাব বা ওয়াজিব কোনটিই নয়।
রোযার শর্তাবলী
ইতোপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে,রমযান মাসে রোযা রাখা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের জন্যই ফরয। বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক বালেগ নারী-পুরুষকে শরীয়তের পরিভাষায় মুকাল্লিফ বলে। অতএব,বিচারবুদ্ধিহীন বা পাগল ব্যক্তি যতক্ষণ ঐ অবস্থায় থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তার জন্য রোযা ফরয নয় এবং এরূপ অবস্থায় সে রোযা রাখলেও তা সহীহ হবে না। তেমনি নাবালেগের জন্য রোযা ফরয নয়। তবে নাবালেগ যদি ভাল-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে তাহলে সে রোযা রাখলে তা সহীহ হবে। তেমনি রোযা সহীহ হবার জন্য রোযাদারের মুসলমান হওয়া ও রোযার নিয়্যত (রোযা রাখার উদ্দেশ্য পোষণ) করা অপরিহার্য। তাই সর্বসম্মত মত হচ্ছে এই,অমুসলিমের রোযা অথবা নিয়্যতবিহীন রোযা কবুল হবে না। ইতোপূর্বে ঋতুস্রাব,সন্তান প্রসব-পরবর্তী রক্তস্রাব,অসুস্থতা ও সফর সংক্রান্ত যে সব শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বর্তমান শর্তদুটি তা থেকে স্বতন্ত্র।
নেশাগ্রস্ততা ও সংজ্ঞাহীনতা
এ সম্পর্কে শাফেয়ী মাজহাবের মত হচ্ছে,একটি রোযার পুরো সময়ের মধ্যেও যদি তারনেশা না কাটে বা সংজ্ঞা না ফেরে তাহলে তার রোযা সহীহ হবে না;কিন্তু নেশার সময়ে কোন এক অংশে যদি সে স্বাভাবিক হয় তাহলে তার রোযা সহীহ হবে যদিও সংজ্ঞাহীনতার ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তিকে ক্বাযা করতে হবে তা সে স্বেচ্ছাধীন কারণে সংজ্ঞাহীন হয়ে থাকুক বা অনিচ্ছাকৃতভাবে। কিন্তু নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে যদি তার নেশাগ্রস্ততার জন্য দায়ী হয়ে না থাকে তাহলে তাকে ক্বাযা করতে হবে না।
মালিকী মাজহাবের মতে সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিনের পুরো সময় বা বেশির ভাগ সময় নেশাগ্রস্ত বা সংজ্ঞাহীন থাকলে রোযা সহীহ হবে না,কিন্তু সে যদি দিনের অর্ধেক বা কম সময় এ অবস্থায় থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় রোযার নিয়্যত করার পরে নেশাগ্রস্ত বা সংজ্ঞাহীন হয়ে থাকে তাহলে তাকে ক্বাযা করতে হবে না। তাদের মতে রোযার নিয়্যত করার সময় হচ্ছে সূর্যাস্ত থেকে সুবহে সাদেক পর্যন্ত।
হানাফী মতে একজন সংজ্ঞাহীন ব্যক্তির অবস্থা হচ্ছে ঠিক একজন বিচারবুদ্ধিহীন বা পাগল ব্যক্তির ন্যায়। আর পাগল সম্পর্কে তাদের মত হচ্ছে,পাগলের পাগলামীর অবস্থা যদি পুরো রমযান মাস অব্যাহত থাকে তাহলে তাকে ক্বাযা করতে হবে না,কিন্তু সে যদি অর্ধেক মাস পাগল থাকে তাহলে সে বাকী অর্ধেক মাস রোযা রাখবে এবং পাগল থাকার কারণে বাদ পড়া দিনগুলোর রোযা পরে ক্বাযা করবে।
হাম্বলী মতে সংজ্ঞাহীন ও নেশাগ্রস্ত উভয় ব্যক্তিকেই ক্বাযা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংজ্ঞাহীনতা বা নেশাগ্রস্ততা স্বেচ্ছাকৃত,না অনিচ্ছাকৃত তাতে কোন পার্থক্য নেই।
ইমামী মতে ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক,কেবল নেশাগ্রস্ততার জন্যই ক্বাযা করতে হবে। সংজ্ঞাহীন ব্যক্তিকে ক্বাযা করতে হবে না,এমন কি সংজ্ঞাহীনতা খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও নয়।
রোযা ভঙ্গের কারণসমূহ
নিম্নলিখিত কার্যাবলী রোযা ভঙ্গ হবার কারণ। এ কারণে রোযা অবস্থায় অর্থাৎ সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত (ইমামীদের মতে পূর্ব আকাশের লালিমা কেটে গিয়ে যখন তা সাদা হয়ে যায় এবং মধ্য আকাশ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে;কিন্তু পশ্চিম আকাশে লালিমা থাকে ঐ সময়টিই হলো ইফতারের সময়।)এ সব কাজ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য :
১. পানাহার : ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করা,খাওয়া বা পান করা উভয় কাজের ফলেই রোযা ভঙ্গ হয় ও ক্বাযা করা অপরিহার্য হয়। এ ব্যাপারে সকল মাজহাবই একমত। কিন্তু সেই সাথে কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে কিনা এ প্রশ্নে মতপার্থক্য রয়েছে। হানাফী ও ইমামীদের মতে কাফ্ফারাহ্ও দিতে হবে কিন্তু শাফেয়ী ও হাম্বলীদের মতে কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে না।
ভুলবশত পানাহার করলে ক্বাযা বা কাফ্ফারাহ্ কোনটিই বর্তাবে না কিন্তু মালিকীদের মতে ক্বাযা করতে হবে।(তামাক ও তামাকজাতীয় দ্রব্যের ধূমপানও পান হিসেবে গণ্য।)
২. যৌন সঙ্গম : ইচ্ছাকৃত যৌন সঙ্গমের ফলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যায় এবং এ ক্ষেত্রে ক্বাযা ও কাফ্ফারাহ্ উভয়ই অপরিহার্য- এ ব্যাপারে সকল মাজহাবই একমত পোষণ করে।
এ ক্ষেত্রে কাফ্ফারাহ্ হচ্ছে একজন ক্রীতদাসকে মুক্ত করা;তা সম্ভব না হলে একাদিক্রমে দুই মাস রোযা রাখা;তাও সম্ভব না হলে ষাটজন মিসকিনকে খাওয়ানো।
ইমামী ও মালিকীদের মতে মুকাল্লিফ এ তিনটি কাজের অর্থাৎ দাসমুক্তকরণ,দুই মাস রোযা রাখা ও ষাটজন মিসকিনকে খাওয়ানোর মধ্য থেকে যে কোন একটি বেছে নিতে পারে। শাফেয়ী,হানাফী ও হাম্বলীদের মতে উপরোল্লিখিত পর্যায়ক্রমিক নিয়মে কাফ্ফারাহ্ আদায় করতে হবে অর্থাৎ দাসমুক্তকরণ সুনির্দিষ্টভাবে ওয়াজিব,কেবল তাতে সক্ষম না হলে তখনই ষাট দিন রোযা রাখা ওয়াজিব হবে,আর তাও যদি সম্ভব না হয় কেবল তখনই মিসকিনদের খাওয়ানো ওয়াজিব হয়।
ইমামীদের মতে যে কাজের মাধ্যমে রোযা ভঙ্গ করা হয় যদি সে কাজটিও মূলত (অর্থাৎ রোযা ছাড়া অন্য সময়েও) হারাম হয়,যেমন জোর করে অন্যের খাবার কেড়ে নিয়ে খাওয়া,মদ পান বা ব্যভিচার,তাহলে একই সাথে উক্ত তিনটি কাফ্ফারাহ্ই ওয়াজিব হবে।
হানাফী,শাফেয়ী ও ইমামীদের মতে ভুলবশত (রোযার কথা মনে না থাকায়) সঙ্গম করে ফেললে রোযা বাতিল হবে না;কিন্তু হাম্বলী ও শাফেয়ীদের মতে রোযা বাতিল হবে।
৩. বীর্যপাত : সকল মাজহাব এ ব্যাপারে একমত,ইচ্ছাকৃত বীর্যপাতের ফলে রোযা বাতিল হবে। হাম্বলীদের মতে বার বার দৃষ্টিপাতের কারণে যৌন উত্তেজনাবশত যৌনরস (মযী)- যা বীর্য নয় তা বের হলেও রোযা বাতিল হবে। আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মতে স্বেচ্ছাকৃত বীর্যপাতের কারণে ক্বাযা ওয়াজিব হবে,কাফ্ফারাহ্ নয়। ইমামীদের মতে ক্বাযা ও কাফ্ফারাহ্ উভয়ই ওয়াজিব হবে।
৪. বমি করা : ইচ্ছা করে বমি করলে রোযা বাতিল হবে এবং ইমামী,শাফেয়ী ও মালিকীদের মতে এজন্য ক্বাযা করতে হবে। হানাফীদের মতে ইচ্ছে করে বমি করলেই রোযা বাতিল হবে না যদি না মুখ ভরে বমি হয়। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল থেকে দুটি বর্ণনাই এসেছে।
পাঁচ মাজহাবের মধ্যে এ ব্যাপারে মতপার্থক্য নেই যে,অনিচ্ছাকৃত বমি রোযা বাতিল করে
৫. শিঙ্গা লাগানো : হাম্বলী মাজহাবের মত অনুযায়ী শরীরে শিঙ্গা লাগিয়ে রক্ত বের করে আনলে শিঙ্গা ব্যবহারকারী ও রোগী উভয়ের রোযাই বাতিল হবে।
৬. ইনজেকশন : সকল মাজহাবের মতেই ইনজেকশন নিলে রোযা বাতিল হবে এবং ক্বাযা করতে হবে। একদল ইমামী ফকীহর মতে অপরিহার্য জরুরী কারণে না হলে কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে।
৭. ঘন ধুলা-বালি : ইমামীদের মতে ঘন ধূলিময় বায়ু শরীরে প্রবেশ করলে রোযা বাতিল হবে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে,ঘন ধূলিময় বায়ু,যেমন ময়দা বা এ জাতীয় অন্য কিছু মিশ্রিত বায়ু শরীরে প্রবেশ করলে রোযা বাতিল হবে। কারণ এ হচ্ছে এমন কিছু যাতে ইনজেকশন বা ধূমপানের চেয়ে বস্তুর পরিমাণ বেশি থাকে।
৮. সুরমা লাগানো : শুধু মালিকীদের মতে সুরমা লাগালে রোযা বাতিল হবে যদি তা দিনের বেলা লাগানো হয় এবং গলায় তার স্বাদ অনুভূত হয়।
৯. নিয়্যত ভঙ্গ করা : কোন ব্যক্তি যদি রোযা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়;কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোযা ভঙ্গকারী কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকে,তাহলে ইমামী ও হাম্বলীদের মতে তার রোযা বাতিল হবে। কিন্তু অন্য তিন মাজহাবের মতে তার রোযা বাতিল হবে না।
১০. পানিতে মাথা ডোবানো : অধিকাংশ ইমামীর মতে শুধু মাথা অথবা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে মাথা পানিতে ডোবালে রোযা বাতিল হবে,তাকে ক্বাযা করতে হবে এবং কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে। অন্য চার মাজহারের মতে এতে রোযা বাতিল হবে না।
১১. যৌন কারণে অপবিত্র (জানাবত) অবস্থায় থাকা : ইমামীদের মতে যে ব্যক্তি রমযান মাসে সুবহে সাদেকের পর পর্যন্ত ইচ্ছাকৃতভাবে জানাবাত অবস্থায় থাকবে তার রোযা বাতিল হবে এবং তাকে ক্বাযা ও কাফ্ফারাহ্ দুই-ই দিতে হবে। অন্য চার মাজহাবের মতে তার রোযা সহীহ হবে এবং তার ওপর ক্বাযা বা কাফ্ফারাহ্ কোনটিই বর্তাবে না।
১২. মিথ্যা বলা : ইমামীদের মতে যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নামে কোন মিথ্যা কথা বলে (যেমন সে যদি বলে বা লেখে,আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল অমুক-অমুক নির্দেশ দিয়েছেন,অথচ সে জানে যে,এ কথা সত্য নয়) তাহলে তার রোযা বাতিল হবে এবং এজন্য তার ওপর ক্বাযা ও কাফ্ফারাহ্ দুই-ই বর্তাবে। একদল ইমামী ফকীহ্ আরো বলেন,এ ধরনের মিথ্যা রচনাকারীর জন্য দাসমুক্তকরণ,দুই মাস রোযা রাখা ও ষাটজন মিসকিনকে খাওয়ানো- একত্রে এই তিনটি কাফ্ফারাহ্ই বর্তাবে। এ থেকে ঐ লোকদের অজ্ঞতা ও বিদ্বেষ পরায়ণতা প্রমাণিত হয় যারা বলে,ইমামীরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা রচনাকে জায়েয গণ্য করে।
বিভিন্ন ধরনের রোযা
বিভিন্ন মাজহাবের ফকীহ্গণ রোযাকে চার ভাগে ভাগ করেছেন : ফরয বা ওয়াজিব,মুস্তাহাব,হারাম ও মাকরুহ।
বাধ্যতামূলক রোযা
ইসলামের সকল মাজহাবের মতে বাধ্যতামূলক রোযা হচ্ছে রমযান মাসের রোযা,তার ক্বাযা,কাফ্ফারাহর রোযা ও মানতের রোযা। ইমামিগণ এই সাথে আরো দুধরনের রোযার কথা বলেন,তা হচ্ছে হজ্ব ও ইতিকাফের সাথে সম্পর্কিত রোযা।
রমযানের ক্বাযা রোযা
১. এ ব্যাপারে ইসলামের সকল মাজহাব একমত,রমযান মাসের রোযা যে বছরে ক্বাযা হয়েছে সে বছরেই আদায় করতে হবে অর্থাৎ যে রমযানে রোযা ক্বাযা হয়েছে তার পরবর্তী রমযানের পূর্বেই ক্বাযা করতে হবে। যে সব দিনে রোযা রাখা হারাম (যার আলোচনা পরে আসছে) সে সব দিন ব্যতীত যে কোন দিনেই ক্বাযা রোযা আদায় করা যাবে। অবশ্য পূর্ববর্তী রমযানে তার যতগুলো রোযা ক্বাযা হয়েছে পরবর্তী রমযান শুরু হতে যদি ততদিন বাকী থাকে সে ক্ষেত্রে কোনরূপ বিলম্ব না করেই ক্বাযা রোযা শুরু করা অপরিহার্য।
২. কেউ যদি যে রমযানের রোযা ক্বাযা হয়েছে তার পরবর্তী রমযান শুরু হবার পূর্বেই তা আদায়ে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও আদায় না করে তাহলে হানাফী ছাড়া বাকী সব মাজহাবের মতে তাকে পরে ঐ রোযা ক্বাযা করা ছাড়াও কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে। কিন্তু হানাফী মতে তাকে শুধু ক্বাযা আদায় করতে হবে,কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে না। কিন্তু সে যদি ঐ বছরের মধ্যে ক্বাযা আদায় করতে অসমর্থ হয়,উদাহরণস্বরূপ ক্বাযা হওয়া রমযান ও পরবর্তী রমযান পর্যন্ত পুরো সময় যদি সে অসুস্থ থাকে তাহলে আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মতে তাকে ক্বাযাও করতে হবে না,কাফ্ফারাহ্ও দিতে হবে না। অন্যদিকে ইমামীদের মতে এ অবস্থায় তাকে ক্বাযা আদায় করতে হবে না,তবে ক্বাযা হওয়া প্রতিটি রোযার জন্য এক মুদ্দ পরিমাণ কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে।
৩. কেউ যদি ক্বাযা হওয়া বছরের মধ্যেই ক্বাযা রোযা আদায় করতে সমর্থ হয়,কিন্তু তা পরবর্তী রমযান শুরুর অব্যবহিত পূর্বে আদায় করতে সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু অতঃপর বৈধ কারণেই পরবর্তী রমযানের পূর্বে তা আদায়ে অসমর্থ হয়,এ অবস্থায় তার ওপর শুধু ক্বাযা বর্তাবে,কাফ্ফারাহ্ বর্তাবে না।
৪. যদি কোন সঙ্গত কারণে কোন ব্যক্তির রোযা ক্বাযা হয় এবং পরে সে ক্বাযা আদায়ে সমর্থ হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও তার জীবদ্দশায় তা আদায় করতে ব্যর্থ হয়,তাহলে ইমামীদের মতে তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্য তার পক্ষ থেকে ঐ ক্বাযা রোযা আদায় করা ওয়াজিব হবে।
হানাফী,শাফেয়ী ও হাম্বলীদের মতে এরূপ অবস্থায় তার পক্ষ থেকে বাদ যাওয়া প্রতিটি রোযার বিনিময়ে এক মুদ্দ হিসেবে সাদাকাহ্ দিতে হবে। মালিকী মাজহাবের মতে সে যদি অসিয়ত করে যায় তাহলে তার পক্ষ থেকে তার বৈধ অভিভাবক (ওয়ালী)-এর জন্য এ সাদাকা প্রদান ওয়াজিব হবে। অসিয়ত না করে থাকলে ওয়াজিব হবে না।
৫. আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মতে কোন ব্যক্তি রমযানের ক্বাযা রোযা রেখে অতঃপর মধ্যদুপুরের পূর্বে বা পরেই হোক,নিয়্যত পরিবর্তন করতে পারবে,এজন্য তাকে কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে না যদি পরে (পরবর্তী রমযানের পূর্বেই) তা আদায়ের সময় থাকে।
ইমামীদের মতে কেবল মধ্য দুপুরের পূর্বে সে রোযা ভঙ্গ করতে পারবে,পরে নয়। কারণএকটি রোযার পুরো সময়ের বেশির ভাগ অতিক্রান্ত হবার পর রোযা অব্যাহত রাখা বাধ্যতামূলক এবং মধ্যদিনের পর নিয়ত পরিবর্তনের অনুমতি নেই। এমতাবস্থায় যদি সে মধ্যদিনের পর রোযা ভঙ্গ করে তাহলে তাকে কাফ্ফারাহ্স্বরূপ দশজন দরিদ্রকে খাবার দিতে হবে। আর তাতে যদি অসমর্থ হয় তাহলে তাকে কাফ্ফারাহ্স্বরূপ তিন দিন রোযা রাখতে হবে।
কাফ্ফারাহর রোযা
কাফ্ফারাহর রোযা বিভিন্ন ধরনের। এর মধ্যে রয়েছে অনিচ্ছাকৃত হত্যার কাফ্ফারাহর রোযা,শপথ (কসম) ও মানত ভঙ্গের কাফ্ফারাহর রোযা ও যেহার৩ -এর কাফ্ফারাহর রোযা। এসব ধরনের কাফ্ফারাহর রোযার জন্যই সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এর প্রতিটি সম্পর্কেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আলোচনার সময় আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে আমরা রমযানের রোযা না রাখা-জনিত কাফ্ফারাহর রোযার নিয়মাবলী সম্পর্কে আলোচনা করব।
শাফেয়ী,মালিকী ও হানাফীদের মতে ইচ্ছাকৃতভাবে রমযানের কোন রোযা ভাঙ্গার কারণে কাফ্ফারাহ্স্বরূপ যার ওপর অবিচ্ছিন্নভাবে দুই মাস রোযা রাখা ওয়াজিব তার জন্য এর মধ্যে থেকে একটি রোযাও বাদ দেয়ার অনুমতি নেই। কারণ তাহলে এর ধারাবাহিকতা বা অবিচ্ছিন্নতা নষ্ট হবে। বিনা ওযরে বা ওযর বশতও যদি সে এ দুই মাসের মধ্য থেকে কোন রোযা ভঙ্গ করে বা বাদ দেয় তাহলে তাকে পুনরায় দুই মাসই রোযা রাখতে হবে।
হাম্বলীদের মতে সে যদি বৈধ কারণে কোন রোযা রাখতে ব্যর্থ হয় তাহলে ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে বলে গণ্য হবে না।
ইমামীদের মতে ধারাবাহিকতার শর্ত পূরণের জন্যে এটিই যথেষ্ট যে,সে প্রথম এক মাস বিরতি ব্যতিরেকেই রোযা রাখবে এবং পরবর্তী মাসের কমপক্ষে প্রথম রোযাটি রাখবে। এরপর সে কয়েকদিন বাদ দিয়ে যতদিনের রোযা বাকী ছিল ততদিন রোযা রাখতে পারে। কিন্তু বৈধ কারণ ব্যতীত সে যদি প্রথম মাসের একটি রোযাও বাদ দেয় বা ভঙ্গ করে তাহলে তাকে নতুন করে শুরুকরতে হবে। কিন্তু যদি কোন বৈধ কারণে ভঙ্গ করে,যেমন অসুস্থতা বা ঋতুস্রাবের কারণে,তাহলে তার ধারাবাহিকতা ভঙ্গ হয়েছে বলে গণ্য হবে না এবং সে ওযর দূরীভূত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে,অতঃপর অবশিষ্ট রোযা রাখা শুরু করবে।
ইমামিগণ আরো বলেন,যার পক্ষে দুই মাস রোযা রাখা বা দাসমুক্ত করা বা ষাটজন মিসকিনকে খাওয়ানো সম্ভব নয়,সে হয় ১৮ দিন রোযা রাখবে নয়ত সামর্থ্য অনুযায়ী সাদাকা প্রদান করবে। এর কোনটিই সম্ভব না হলে সে আল্লাহ তায়ালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
শাফেয়ী,মালিকী ও হানাফীদের মতে কোন ব্যক্তি যদি কোন ধরনের কাফ্ফারাহ্ আদায়েই সক্ষম না হয় তাহলে সামর্থ্যরে অধিকারী না হওয়া পর্যন্ত তার ওপরে এর দায়িত্ব থেকে যাবে এবং শরীয়তের বিধান এটিই দাবী করে। এ ক্ষেত্রে হাম্বলীদের মত হচ্ছে,সে যদি কাফ্ফারাহ্ দিতে অসমর্থ হয় তাহলে তার ওপরে এর কোন দায়িত্ব থাকবে না। অতঃপর সে সামর্থ্যরে অধিকারী হলেও এ ব্যাপারে তার ওপর কোন দায়িত্ব থাকবে না।
ইসলামের সকল মাজহাব এ ব্যাপারে একমত,কাফ্ফারাহর সংখ্যা হবে তার কারণের সংখ্যার সমান। অতএব,কোন ব্যক্তি দুটি রোযা ভঙ্গ করলে তাকে দুটি কাফ্ফারাহ্ আদায় করতে হবে। কিন্তু সে যদি একই দিনের মধ্যে একাধিকবার পানাহার করে বা যৌনসঙ্গম করে,তাহলে হানাফী,মালিকী ও শাফেয়ীদের মতে রোযা ভঙ্গের কারণ একাধিকবার ঘটলেও- তা যে কোন ধরনের কারণই হোক না কেন,তার কাফ্ফারাহর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না।
হাম্বলীদের মতে কোন ব্যক্তি দ্বারা একই দিনে যদি কাফ্ফারাহ্ দেয়ার মত কাজ একাধিক বার সংঘটিত হয় এবং সে যদি দ্বিতীয়বার লঙ্ঘনমূলক কাজের পূর্বেই কাফ্ফারাহ্ দিয়ে থাকে তাহলে তাকে পরবর্তী লঙ্ঘনের জন্যও একইভাবে কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে। কিন্তু যদি সে দ্বিতীয় লঙ্ঘনের পূর্বে প্রথম লঙ্ঘনের কাফ্ফারাহ্ না দিয়ে থাকে তাহলে একবার কাফ্ফারাহ্ দেয়াই তার জন্য যথেষ্ট হবে।
ইমামীদের মতে ব্যক্তি যদি এক দিনের মধ্যে একাধিকবার যৌনসঙ্গম করে থাকে তাহলে তাকে প্রতি বারের জন্য আলাদা কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে;কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি একদিনে একাধিকবার পানাহার করে থাকে তাহলে তার জন্য একটি কাফ্ফারাহ্ দেয়াই যথেষ্ট হবে।
হারাম রোযা
হানাফী বাদে অন্য চার মাজহাব এ ব্যাপারে একমত,ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিনগুলোতে রোযা রাখা হারাম। হানাফী মতে এ দুই ঈদের দিনগুলোতে রোযা রাখা মাকরুহ এবং তার মাকরুহ অবস্থা হারামের কাছাকাছি (মাকরুহ তাহরীমী)।
ইমামীদের মতে আইয়ামে তাশরীক-এর দিনগুলোতে কেবল মীনায় অবস্থানকারীদের জন্য রোযা রাখা হারাম। উল্লেখ্য,যিলহজ্ব মাসের একাদশ,দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ দিবসকে আইয়ামে তাশরীক বলা হয়।
শাফেয়ীদের মতে হজ্বব্রত পালনকারী ও অন্যদের জন্য তথা কারো জন্যই আইয়ামে তাশরীক-এর দিনগুলোতে রোযা রাখলে তা সহীহ হবে না।
হাম্বলীদের মতে উক্ত দিনগুলোতে হজ্বরত নয় এমন লোকদের জন্য রোযা রাখা হারাম কিন্তু হজ্ব পালনরতদের জন্য হারাম নয়।
হানাফীদের মতে এ দিনগুলোতে রোযা রাখা মাকরুহ,তবে হারামের কাছাকাছি।
মালিকীদের মতে যিলহজ্বের একাদশ ও দ্বাদশ দিনে হজ্ব পালনরত নয় এমন লোকদের জন্য রোযা রাখা হারাম,তবে হজ্ব পালনরতদের জন্য হারাম নয়।
হানাফী ছাড়া অন্য সকল মাজহাব এ ব্যাপারে একমত,কোন নারী নফল রোযা রাখলে যদি তার স্বামীর কোন অধিকার আদায়ে ব্যাঘাত ঘটে তাহলে তার জন্য স্বামীর অনুমতি ছাড়া এ ধরনের রোযা রাখা সহীহ হবে না। হানাফী মতে স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল রোযা রাখা মাকরুহ,হারাম নয়।
সন্দেহের দিনসমূহ
সকল মাজহাব এ ব্যাপারে একমত,যে ব্যক্তি সন্দেহের দিনে রোযা রাখে নি এবং পানাহার করেছে কিন্তু পরে নিশ্চিত হয়েছে যে,ঐ দিনটি রমযানের একটি দিন,অতঃপর ঐ সময় থেকে তার জন্য রোযা ভঙ্গকারী কাজ হতে বিরত থাকা অপরিহার্য এবং পরে তাকে ঐ দিনের রোযা ক্বাযা করতে হবে।
কোন ব্যক্তি যদি সন্দেহের দিনে রোযা রাখে এবং পরে জানা যায় যে,দিনটি রমযানেরই একটি দিন তাহলে ঐ রোযা তার ঐ দিনের রোযা হিসেবে ক্বাযা ছাড়াই যথেষ্ট হবে কিনা এ ব্যাপারে মতপার্থক্য আছে।
শাফেয়ী,মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের মতে এ রোযা তার জন্য যথেষ্ট নয়,বরং তাকে ক্বাযা আদায় করতে হবে। হানাফীদের মতে এ রোযাই তার জন্য যথেষ্ট এবং তাকে ক্বাযা করতে হবেনা। অধিকাংশ ইমামী ফকীহর মতে তার ওপরে এর ক্বাযা ওয়াজিব নয়,কিন্তু সে যদি রমযানের রোযার নিয়্যতে রোযা রেখে থাকে তাহলে তাকে ক্বাযা আদায় করতে হবে।
মুস্তাহাব রোযা
যে সব দিনে রোযা রাখা হারাম তদ্ব্যতীত বছরের যে কোন দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। কিন্তু এমন কতক দিন রয়েছে যেসব দিনে মুস্তাহাব রোযা রাখার ওপর বিশেষভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখা। এ ক্ষেত্রে চান্দ্র মাসের ত্রয়োদশ,চর্তুদশ ও পঞ্চদশ দিবসকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। আরাফাহর দিবস (নয় যিলহজ্ব বা হজ্বের দিন)-ও এর অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া রজব ও শাবান মাসে মুস্তাহাব রোযা রাখার ব্যাপারে তাগিদ করা হয়েছে। সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখার ওপরও তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরো কতগুলোদিনে মুস্তাহাব রোযার কথা বলা হয়েছে যা বিস্তারিত আলোচনার বিষয়। তবে উপরোক্ত দিনগুলোর রোযা মুস্তাহাব হবার ব্যাপারে সকল মাজহাব একমত।
মাকরুহ রোযা
আল ফিকহু আলাল মাজাহিবিল আরবাআহ্ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে,রোযা রাখার জন্য শুধু শুক্রবার বা শনিবারকে নির্দিষ্ট করা মাকরুহ। একইভাবে নওরোযের দিনে (২১ মার্চ) রোযা রাখা মাকরুহ বলে শাফেয়ী বাদে অন্য সব মাজহাব অভিন্ন মত প্রকাশ করেছে। একইভাবে রমযানের অব্যবহিত পূর্ববর্তী একদিন বা দুইদিন রোযা রাখা মাকরুহ।
ইমামী মাজহাবের ফিকাহর গ্রন্থাবলীতে বলা হয়েছে,মেযবানের অনুমতি ছাড়া মেহমানের ও পিতার অনুমতি ছাড়া নাবালেগ সন্তানের রোযা মাকরুহ। তেমনি যিলহজ্ব মাসের চাঁদ উদিত হবার ব্যাপারে সন্দেহের কারণে যেদিন ঈদের দিন হবার সম্ভাবনা থাকে সেদিন রোযা রাখা মাকরুহ।
নতুন চাঁদ দেখা
মুসলমানদের মধ্যে এ ব্যাপারে মতৈক্য (ইজমা) রয়েছে,যে ব্যক্তি নিজে নতুন চাঁদ দেখেছে সে তার নিজের জানার ভিত্তিতে আমল করতে বাধ্য,তা সে চাঁদ রমযান মাসেরই হোক বা শাওয়াল মাসেরই হোক। এ ক্ষেত্রে যে রমযানের চাঁদ দেখেছে তার জন্য সে হিসেবে রোযা রাখা অপরিহার্য,এমন কি অন্য সমস্ত মানুষ যদি চাঁদ না দেখে থাকে এবং রোযা রাখা হতে বিরত থাকে।৫ তেমনি শাওয়াল মাসের চাঁদের ক্ষেত্রে সারা দুনিয়ার মানুষ যদি রোযা রাখে তথাপি যে চাঁদ দেখেছে সে তদনুযায়ী আমল করতে বাধ্য। অর্থাৎ সে রোযা রাখা হতে বিরত থাকবে। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি চাঁদ দেখেছে সে ন্যায়পরায়ণ কিনা তাতে কোন পার্থক্য নেই;নারী-পুরুষেও কোন পার্থক্য নেই।
এ ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়ে বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে :
১. হাম্বলী,মালিকী ও হানাফীদের মতে কোন সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে চাঁদ দেখা যাবার বিষয়টি যদি নিশ্চিত হয় তাহলে দূরত্ব নির্বিশেষে অন্য সকল অঞ্চলের লোকদের জন্য তার অনুসরণ বাধ্যতামূলক,নতুন চাঁদের উদয়স্থল কোন বিবেচ্য বিষয় নয়।
ইমামী ও শাফেয়ীদের মতে কোন বিশেষ জায়গার লোকেরা যদি নতুন চাঁদ দেখতে পায় এবং অন্য একটি জায়গার লোকেরা দেখতে না পায়,এ ক্ষেত্রে উদয়-দিগন্তের বিচারে এ উভয় স্থান যদি কাছাকাছি হয় তাহলে দ্বিতীয় স্থানের লোকদের করণীয় প্রথমোক্তদের অনুরূপ হবে,কিন্তু উদয়-দিগন্ত স্বতন্ত্র হলে হবে না।
২. ত্রিশ শাবান মধ্যদিনের পূর্বে বা পরে নতুন চাঁদ দেখা গেলে দিনটিকে কি শাবানের শেষ দিন গণ্য করতে হবে (যেদিন রোযা রাখা ওয়াজিব নয়) না রমযানের প্রথম দিন গণ্য করতে হবে (যেদিন রোযা রাখা ওয়াজিব)? একইভাবে রমযানের ৩০তম দিনে মধ্যদিনের পূর্বে বা পরে চাঁদ দেখা গেলে দিনটিকে কি রমযানের শেষ দিন গণ্য করতে হবে না শাওয়ালের প্রথম দিন? অন্যকথায় যে দিনটিতে চাঁদ দেখা যাবে সে দিনটি কি পূর্ববর্তী মাসের মধ্যে গণ্য হবে না পরবর্তী মাসের মধ্যে গণ্য হবে?
এ ব্যাপারে ইমামী,শাফেয়ী,হাম্বলী,মালিকী ও হানাফীদের মত হচ্ছে,এ দিনটি পূর্ববর্তী মাসের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে,পরবর্তী মাসের মধ্যে গণ্য হবে না। অতএব,শাবানের শেষ দিন নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন থেকে রমযানের রোযা রাখতে হবে এবং রমযানের শেষ দিনে নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন রোযা না রেখে ঈদ করতে হবে।
৩. সকল মাজহাব এ ব্যাপারে একমত,হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উক্তি অনুযায়ী কেবল দেখার মাধ্যমেই নতুন চাঁদের উদয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে যেখানে তিনি বলেছেন,“ তোমরা (নতুন চাঁদ) দেখে রোযা রাখ এবং (নতুন চাঁদ) দেখে রোযাবন্ধ কর।” কিন্তু চন্দ্র উদয়ের বিষয়ে অন্যান্য পন্থায় নিশ্চিত হওয়া যাবে কিনা এ ব্যাপারে বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
ইমামীদের মতে রমযান ও শাওয়ালের ক্ষেত্রে মুতাওয়াতির সাক্ষ্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যাবে। মুতাওয়াতির হচ্ছে এত বেশি লোকের সাক্ষ্য যাদের পক্ষে একত্র হয়ে মিথ্যা দাবী প্রমাণের জন্য ষড়যন্ত্র করা সম্ভব নয়। একইভাবে দুজন আদেল (ন্যায়পরায়ণ) ব্যক্তির সাক্ষ্যও যথেষ্ট হবে। এক্ষেত্রে আকাশ পরিষ্কার থাকুক বা মেঘলা থাকুক এবং তারা একই শহরের অধিবাসী বা কাছাকাছি দুই শহরের অধিবাসী হোন,তাতে কোন পার্থক্য নেই। তবে শর্ত হচ্ছে নতুন চাঁদ সম্পর্কে তাদের বর্ণনা পরস্পর বিরোধী হবে না। এ ক্ষেত্রে নারী,শিশু,ফাসেক পুরুষ লোক ও যাদের চরিত্র সম্পর্কে জানা নেই তাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না।
হানাফী মাজহাবে রমযান ও শাওয়ালের চাঁদের ব্যাপারে পার্থক্য করা হয়েছে। তাদের মতে মুসলিম,বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ও আদেল একজন পুরুষ ও একজন নারী রমযানের নতুন চাঁদ দেখলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু শাওয়ালের চাঁদ দেখার বিষয়টি এ ধরনের দুজন পুরুষ বা একজন পুরুষ ও দুইজন নারী না দেখলে গ্রহণীয় হবে না। এ হচ্ছে যখন আকাশ পরিষ্কার না থাকে সে সময়কার কথা। কিন্তু আকাশ পরিষ্কার থাকলে এত বেশি সংখ্যক লোকের সাক্ষ্য প্রয়োজন হবে যাতে সাক্ষ্যের সত্যতা সম্পর্কে মানসিক নিশ্চিন্ততা সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে রমযান ও শাওয়ালের চাঁদ দেখার মধ্যে কোন পার্থক্য হবে না।
শাফেয়ী মাজহাবের মতে সাক্ষ্যদাতা যদি মুসলমান,সুস্থ বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন ও আদেল হয় তাহলে রমযান ও শাওয়ালের নতুন চাঁদ দেখার ব্যাপারে এরূপ এক ব্যক্তির সাক্ষ্যই যথেষ্ট হবে। এ ক্ষেত্রে আকাশ পরিষ্কার বা মেঘলা থাকায় কোন পার্থক্য হবে না।
মালিকীদের মতে আকাশ পরিষ্কার থাক বা মেঘলা থাক,দুজন আদেল ব্যক্তির সাক্ষ্য ব্যতিরেকে রমযান বা শাওয়ালের নতুন চাঁদ দেখা যাওয়া সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
হাম্বলী মতে রমযানের নতুন চাঁদ দেখা যাবার ব্যাপারে একজন আদেল পুরুষ বা নারীর সাক্ষ্য থেকেই নিশ্চিত হওয়া যাবে;কিন্তু শাওয়ালের চাঁদ দেখা যাবার ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য দুজন আদেল পুরুষের সাক্ষ্য প্রয়োজন হবে।
হানাফী ছাড়া অন্য চার মাজহাব এ ব্যাপারে একমত,কেউই যদি রমযানের নতুন চাঁদ দেখেছে বলে দাবী না করে তাহলে শাবান মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করার পর রমযানের রোযা শুরু করতে হবে। কিন্তু হানাফী মাযহাব মতে শাবান মাসের উনত্রিশতম দিনের পরই রমযানের রোযা ওয়াজিব হবে।
এটি ছিল রমযানের নতুন চাঁদের সাথে সম্পৃক্ত। শাওয়ালের নতুন চাঁদ সম্বন্ধে হানাফী ও মালিকী মাজহাবের মত হচ্ছে,আকাশ মেঘলা থাকলে রমযান ত্রিশ দিন পূর্ণ করতে হবে এবং পরদিন রোযা না রাখা (তথা ঈদুল ফিতর উদ্যাপন) ওয়াজিব হবে। কিন্তু আকাশ পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও রমযানের ত্রিশতম দিনে চাঁদ দেখা না গেলে পরদিন রোযা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে রমযানের চাঁদ দেখার ব্যাপারে যে সাক্ষ্য পাওয়া গিয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে- তা সাক্ষীর সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন।
শাফেয়ী মাজহাবের মতে আকাশ পরিষ্কার বা মেঘলা যা-ই থাক,এমন কি এক ব্যক্তিও যদি রমযানের চাঁদ দেখে থাকে এবং তার ভিত্তিতে রোযা শুরু হয়ে থাকে,তথাপি রমযানের ত্রিশ দিন পূর্ণ হবার পরবর্তী দিন রোযা না রাখা ওয়াজিব হবে।
হাম্বলী মতে যদি দুজন আদেল ব্যক্তির সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রমযানের রোযা শুরু হয়ে থাকে তাহলে রমযানের ত্রিশ দিন পূর্ণ হবার পর রোযা না রাখা ওয়াজিব হবে। কিন্তু রমযানের রোযা যদি একজন আদেল ব্যক্তির সাক্ষ্যের ভিত্তিতে শুরু হয়ে থাকে তাহলে একত্রিশতম দিনেও রোযা রাখা ওয়াজিব হবে।
ইমামী মাজহাবের মতে রমযান ও শাওয়াল উভয় মাসই শরীয়ত অনুমোদিত পন্থায় শুরু হতে হবে,নয়ত ত্রিশ দিন পূর্ণ করার পরে শুরু হবে,এ ক্ষেত্রে আকাশ পরিষ্কার বা মেঘলা থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
নতুন চাঁদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান
১৯৬০ সালে পাকিস্তান ও তিউনিসিয়ার সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে,বিভ্রান্তি এড়ানো৬ ও ঈদের ব্যাপারে সর্বসাধারণের সুবিধার্থে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সহায়তা নেবে। কারণ দেখা গেছে কোন কোন সময় মানুষ ঈদের জন্য প্রস্তুত না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করেই ঈদ এসে যায়,আবার কোন কোন সময় ঈদের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও ঈদ এক দিন পিছিয়ে যায়। উক্ত দুই দেশের এ সিদ্ধান্ত ধর্মীয় মহলে উত্তপ্ত বিতর্কের সৃষ্টি করে। উক্ত সিদ্ধান্তের সমর্থকগণ অভিমত ব্যক্ত করে যে,ধর্মে এমন কোন কিছু নেই যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতের ওপর নির্ভর করতে নিষেধ করে,বরং সূরা নাহলের ১৬ নং আয়াতে এর প্রতি সমর্থন পাওয়া যায়। এ আয়াতে বলা হয়েছে : আর তারা পদচিহ্নসমূহ ও নক্ষত্রাদির সাহায্যে পথনির্দেশ লাভ করে।
কিন্তু এ সিদ্ধান্তের বিরোধীরা বলেন,এ সিদ্ধান্ত হযরত রাসূল (সা.)-এর উক্তির সাথে সাংঘর্ষিক যেখানে তিনি বলেছেন,“তোমরা (নতুন চাঁদ) দেখে রোযা শুরু কর এবং (নতুন চাঁদ) দেখে রোযা বন্ধ কর।” কারণ এখানে রুইয়াহ্ শব্দ ব্যবহার করাহয়েছে যার অর্থ হচ্ছে চোখ দ্বারা দেখা- যা রাসূল (সা.)-এর যুগে সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল। তাদের মতে টেলিস্কোপ ব্যবহার বা জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশের ওপর নির্ভরতা উক্ত হাদীসের আক্ষরিক তাৎপর্যের সাথে সাংঘর্ষিক।
প্রকৃত অর্থে দুই পক্ষের কোন পক্ষই মজবুত যুক্তি উপস্থাপন করতে সক্ষম হয় নি। কারণ তারকারাজির দ্বারা পথনির্দেশ লাভ বলতে তারকারাজির অবস্থান দৃষ্টে সমুদ্র বক্ষ ও স্থলভাগে চলার পথ বা দিক নির্ণয় বোঝায়,মাসের দিনসমূহ ও নতুন চাঁদ উদয়ের দিন নির্ণয় বোঝায় না। অন্যদিকে উক্ত হাদীস অকাট্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে বাতিল করে দেয় না। কারণ দেখা হচ্ছে কোন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। দেখা স্বয়ং লক্ষ্য নয়,ঠিক যেভাবে অন্য যে কোন ক্ষেত্রে নিশ্চিত জ্ঞানে উপনীত হবার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্য নেয়া হয়।
যা-ই হোক,আমার মতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতামত কোন অকাট্য জ্ঞানে উপনীত করে না এবং চাক্ষুষ দর্শনের দ্বারা যেভাবে সন্দেহ দূরীভূত হয় তাঁদের তথ্য দ্বারা সেভাবে হয় না। কারণ তাঁদের মতামত সম্ভাব্যতার ওপর ভিত্তিশীল,নিশ্চয় তার ওপর নয়। ঠিক কখন দিগন্তে নতুন চাঁদ উদিত হবে- এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে যে মতের বিভিন্নতা দেখা যায় তা থেকেই আমার এ মতের যথার্থতা প্রমাণিত হয়।
ভবিষ্যতে কখনো যদি জ্যোতির্বিজ্ঞানিগণ এ ব্যাপারে সঠিক ও যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন যার ফলে তাঁরা নিজেরা এ বিষয়ে অভিন্ন মতে পৌঁছতে ও তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণীকে নির্ভুলভাবে সত্য প্রমাণিত করতে পারেন তখন তাঁদের মতের ওপর নির্ভর করা যাবে,বরং তাঁদের মতামতের অনুসরণ করা ও তাঁদের মতের সাথে সাংঘর্ষিক অন্য সকল মত প্রত্যাখ্যান করা অপরিহার্য হবে।৬
[জনাব নূর হোসেন মজিদী কর্তৃক অনূদিত অত্র আলোচনাটি লেখকের বিখ্যাত গ্রন্থ আল ফিকহু আলাল মাজাহিবিল খামসাহ্-এর আসসিয়াম অধ্যায়ের অনুবাদ। বাংলায় অনুবাদের ক্ষেত্রে কাযিম পুর জাওয়াদী-কৃত ফার্সী অনুবাদ ফেকহে তাতবিকী মাজাহেবে পাঞ্জগনেহ এবং তেহরান থেকে প্রকাশিত `Al-Tawhid সাময়িকীর নবম বর্ষ,৪র্থ সংখ্যায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ের Mujahid Husayn-কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে সহায়তা নেয়া হয়েছে।]
পাদটীকা ও তথ্যসূত্র
১. ইসলামে যে সব কাজ অপরিহার্যভাবে করণীয়,না করলে আল্লাহর নিকট শাস্তিযোগ্য অপরাধ সে সব কাজ বোঝাতে আরবী ভাষায় প্রধানত ওয়াজিব বলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এজন্য প্রধানত ফরয শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অত্র প্রবন্ধের মূলে এজন্য ওয়াজিব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অনুবাদে আমরা ফরয,ওয়াজিব,বাধ্যতামূলক ও অপরিহার্য- এ চার রকমের পরিভাষা ব্যবহার করেছি। এসব ক্ষেত্রে অভিন্ন অর্থ গণ্য করতে হবে।– অনুবাদক
২. এক মুদ্দ মানে ৮০০ গ্রাম গম বা এ জাতীয় অন্য খাদ্যশস্য।
৩. কেউ যদি রাগের বশে স্ত্রীকে তার মায়ের মত হারাম বলে ঘোষণা করে তাকে যেহার বলে। যেহারের ফলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য হারাম হয়ে যায়,কিন্তু কাফ্ফারাহ্ দিলে পুনরায় হালাল হয়ে যায়।– অনুবাদক
৪. কিন্তু হানাফীদের মতে সে যদি একজন কাযীর সামনে সাক্ষ্য দেয় এবং কাযী তার সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করেতা হলে তার জন্য ক্বাযা আদায় করা ওয়াজিব হবে;তবে কাফ্ফারাহ্ দিতে হবে না।
৫. ১৯৩৯ সালে সোমবার বিকালে মিসরে,মঙ্গলবার সউদী আরবে ও বুধবার বোম্বাইয়ে ঈদুল আযহা উদ্যাপিত হয়।
৬. এ প্রসঙ্গে আমার লেখা গ্রন্থ ফিকহুল ইমাম জাফর আস্ সাদিক-এর সাওম অধ্যায়ের শেষে নতুন চাঁদ সংক্রান্ত অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখা যেতে পারে।