বাঙ্গালী
Monday 25th of November 2024
0
نفر 0

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কতিপয় খুতবা,স্লোগান ও কথোপকথন (মদীনা থেকে কারবালা পর্যন্ত)-১ম পর্ব

 ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কতিপয় খুতবা,স্লোগান ও কথোপকথন (মদীনা থেকে কারবালা পর্যন্ত)-১ম পর্ব

মীনায় মদীনার আলেমদের সাথে বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণ

আমীর মু‘আবিয়ার জীবনের শেষ বছরে তথা কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার এক বছর আগে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) পবিত্র মক্কা নগরীর পার্শ্ববর্তী মীনায় মদীনার আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে তিনি নিম্নোক্ত ভাষণ প্রদান করেন :

‘হে লোকসকল! আল্লাহ্ তা‘আলা (বনি ইসরাইলের) আলেমদের যে তিরস্কার করেছেন ও উপদেশ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ কর। তিনি এরশাদ করেছেন :

لَوْلَا يَنْهَاهُمُ الرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ عَن قَوْلِهِمُ الْإِثْمَ وَأَكْلِهِمُ السُّحْتَ

“কেন (তাদের মধ্যকার) রাব্বানিগণ (আরেফ ও দরবেশগণ) ও আলেমগণ তাদের পাপ-কথা বলতে ও হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করল না?” (সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৬৩)

আল্লাহ্ আরও এরশাদ করেছেন :

لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ۚ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا وَّكَانُوا يَعْتَدُونَ ﴿﴾ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ ۚ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ

 

“বনি ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফ্রীতে লিপ্ত হয়েছিল তাদেরকে দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের কণ্ঠে অভিসম্পাত করা হয়। কারণ,তারা নাফরমানী করত ও (আল্লাহর নির্ধারিত) সীমা লঙ্ঘন করত। তারা যে সব মন্দ কাজ করত তা থেকে তারা পরস্পরকে নিষেধ করত না;তারা যা করত তা কতই না নিকৃষ্ট কর্ম!” (সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৭৮-৭৯)

কেন আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের এভাবে তিরস্কার করলেন? কারণ,তারা যালেমদের- পাপাচারীদের যুলুম ও পাপ কাজ করতে এবং ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করতে দেখত,কিন্তু তাদের কাছ থেকে পার্থিব সুযোগ-সুবিধা লাভ ও যুলুমের হাত থেকে নিরাপদ থাকার উদ্দেশ্যে তাদের এ সব থেকে নিষেধ করত না। অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন :

فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ

 “...তোমরা লোকদের ভয় কর না,কেবল আমাকেই ভয় কর...।”(সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৪৪)

তিনি আরও এরশাদ করেছেন :

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُ‌ونَ بِالْمَعْرُ‌وفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ‌

“আর মু’মিন পুরুষগণ ও নারিগণ পরস্পরের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক;তারা (পরস্পরকে) ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে...।”(সূরা আত্-তাওবাহ্ : ৭১)

আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াতে ভাল কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখাকে সর্বপ্রথম কর্তব্যকাজ (ফরয) হিসাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কারণ,এ ফরয কাজটি আঞ্জাম দেওয়া হলে সহজ ও কঠিন নির্বিশেষে অন্য সমস্ত ফরয কাজই আঞ্জাম দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। এছাড়া ‘ভাল কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখা’ মানে হচ্ছে ইসলামের প্রতি দাওয়াত প্রদান। কারণ,এর মানে হচ্ছে যুলুম-অত্যাচারের উচ্ছেদ সাধন,যালেম-অত্যাচারীদের প্রতি বিরোধিতা প্রদর্শন,বাইতুল মালের সম্পদ ও গনিমতের মাল (সকলের মাঝে সমভাবে) বণ্টনের এবং যাদের ওপর কর প্রযোজ্য তাদের কাছ থেকে কর আদায় করা ও প্রকৃত হকদারদের মধ্যে তা বণ্টন করা।

হে শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ! কল্যাণ ও নেক আমলের জন্য খ্যাতিমান ব্যক্তিগণ! আর অন্যদের নসিহত করা ও উপদেশ দানের জন্য বিখ্যাত লোকেরা! জেনে রেখ,মানুষের অন্তরে তোমাদের জন্য যে ভক্তিশ্রদ্ধা ও মর্যাদা রয়েছে তা কেবল আল্লাহরই কারণে। তারা তোমাদের মধ্যকার শক্তিশালী লোকদের প্রতি আশার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে এবং তোমাদের মধ্যকার দুর্বল ও অক্ষমদের তারা সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। তারা তাদের স্বজনদের তোমাদের জন্য উৎসর্গ করে,যদিও তাদের ওপরে তোমাদের কোনই শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তাদের প্রয়োজন পূরণ না হলে তারা তোমাদের কাছে সুপারিশ চায়,আর তোমরা রাজা-বাদশাহ্দের ন্যায় শান-শওকতের সাথে এবং সমাজের শীর্ষস্থানীয় লোকদের ন্যায় মর্যাদা সহকারে পথ চলে থাক। এ সব কি কেবল এ কারণে সম্ভব হচ্ছে না যে,মানুষ তোমাদের ওপর এ মর্মে আশাবাদী যে,তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত অধিকারসমূহ পুনরুদ্ধারের জন্য রুখে দাঁড়াবে? কিন্তু বেশির ভাগ বিষয়েই তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করেছ এবং ইমামগণের অধিকারসমূহকে খুব হাল্কাভাবে নিয়েছ,আর দুর্বলদের অধিকারকে পয়মাল করেছ।

তোমরা যাকে নিজেদের অধিকার বলে মনে করেছ তা তোমরা অবৈধভাবে হস্তগত করেছ। অথচ তোমরা না আল্লাহর রাস্তায় তোমাদের ধনসম্পদ দান করেছ,না নিজেদের প্রাণ বিপদাপন্ন করেছ,আর না আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজ নিজ গোত্র ও স্বজনদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছ।

বাহ্! এহেন ঘৃণ্য আমল সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা‘আলার বেহেশত লাভের ও নবী- রাসূলগণের প্রতিবেশী হবার এবং খোদায়ী আযাব হতে নিরাপদ থাকার আকাঙ্ক্ষা পোষণের মত কেমন ধৃষ্টতাই না তোমরা দেখাচ্ছ!

ওহে,আল্লাহর কাছে এ ধরনের প্রত্যাশা পোষণকারীরা! আমার ভয় হচ্ছে যে,তোমাদের ওপর হয়ত আল্লাহর পক্ষ থকে আযাব নাযিল হবে। কারণ,তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহে এমন এক অবস্থানে উপনীত হয়েছ যে,অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েছ। এমন কত লোকই না আছে যারা জনগণের মধ্যে সম্মানের পাত্র নয়,অথচ কেবল আল্লাহর জন্য তোমরা তাঁর বান্দাদের মধ্যে সম্মানজনক অবস্থানের অধিকারী। অথচ তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কৃত অঙ্গীকারসমূহ ভঙ্গ হতে দেখছ,কিন্তু এ ব্যাপারে টু-শব্দটিও করছ না এবং এ ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলার ভয়ও সৃষ্টি হচ্ছে না। তোমাদের পূর্বপুরুষদের কতক অঙ্গীকার বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ায় তোমরা বিলাপ করছ,অথচ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তিসমূহকে উপেক্ষা করছ। শহরগুলোতে অনেক অন্ধ লোক আছে,অনেক বোবা লোক আছে,অনেক পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোক আছে,কিন্তু তোমরা না তাদের প্রতি কোন দয়া দেখাচ্ছ,না তোমাদের পক্ষে সম্ভব এমন কোন কাজ তাদের জন্য করছ,না এ ধরনের কাজ করার জন্য নিয়্যত পোষণ করছ;বরং তোমরা কেবল নিজেদের স্বার্থ ও আরাম-আয়েশের জন্য যালেম-অত্যাচারীদের তোষামোদ করছ।

আল্লাহ্ তা‘আলা এ ধরনের নোংরা কাজ প্রতিহত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তোমরা এ ব্যাপারে একেবারেই গাফেল-উদাসীন;তোমরা হচ্ছ সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক লোক। কারণ,তোমরা জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও জেনে-শুনে তোমাদের দায়িত্ব পালন থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছ। অথচ জনসাধারণের কাজকর্ম ও আইন-কানুন বাস্তবায়নের দায়িত্ব আলেমদের হাতে থাকা উচিত- যারা হবে আল্লাহ্ তা‘আলার নির্ধারিত হালাল-হারাম কার্যকরকরণের ব্যাপারে আমানতদার।

কিন্তু এ দায়িত্ব ও এ মর্যাদা তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কারণ,তোমরা সত্যের অক্ষ থেকে দূরে সরে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছ। অকাট্য দলীল- প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তোমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের ব্যাপারে মতানৈক্যে লিপ্ত হয়েছ। দুঃখকষ্টের মোকাবিলায় তোমরা যদি ধৈর্যের পরিচয় দিতে এবং আল্লাহর দীনের পথে কষ্ট ও কাঠিন্য সহ্য করে নিতে তাহলে আল্লাহর দীনের বিষয়াদি কার্যকর করার দায়িত্ব তোমাদের হাতে এসে যেত। কিন্তু তোমরা যালেমদের নিজেদের জায়গায়-নিজেদের পদে ও মর্যাদায় বসিয়েছ এবং আল্লাহর দীনের বিষয়াদি তাদের হাতে সোপর্দ করেছ। আর তারা ভুলভাবে কাজ করে চলেছে এবং স্বীয় প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তোমরা কি জান যে,কেন যালেমরা সকল বিষয়ের কর্তৃত্ব দখল করতে পেরেছে? কারণ,তোমরা মৃত্যুর হাত থেকে পলায়ন করেছ,তোমরা অপসৃয়মান পার্থিব যিন্দেগীর সাথে প্রেমিকসুলভ হৃদয় সহকারে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছ।

এরপর তোমরা দুর্বল ও অসহায় লোকদেরকে যালেমদের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছ;এর ফলে তারা অনেককে তাদের দাস ও অধীনে পরিণত করেছে এবং অনেককে এক লোকমা খাদ্যের জন্য অসহায় ও অক্ষমে পরিণত করেছে। যালেমরা আল্লাহর রাজত্বে স্বেচ্ছাচারিতার সাথে যেমন খুশী পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং তাদের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় পথকে সহজ করে দিচ্ছে। তারা বদমাশ ও নীচ প্রকৃতির লোকদের অনুসরণ করছে এবং ধৃষ্টতার সাথে আল্লাহ্ তা‘আলার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। তারা প্রতিটি শহরেই খুতবার মিম্বারে উঠে বক্তব্য পেশের জন্য বক্তা নিয়োগ করেছে এবং এ বক্তারা চিৎকার করে চলেছে ও উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছে। ধরণী পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং সকল ক্ষেত্রেই তাদের হস্ত উন্মুক্ত ও প্রসারিত। জনগণ এমনভাবে তাদের দাসে পরিণত হয়েছে যে,তাদের মাথায় যে কেউ করাঘাত করুক না কেন,তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা করতে সক্ষম নয়।

এই হিংসুক ও ঈর্ষাকারী উদ্ধত যালেমদের একটি গোষ্ঠী অসহায়দের ওপর অত্যন্ত কঠিনভাবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তাদের একটি গোষ্ঠী হচ্ছে এমন ধরনের শাসক যে,না তারা আল্লাহকে মানে,না তারা শেষ বিচারের দিনের ওপর ঈমান রাখে। আশ্চর্য!

কেনই বা বিস্মিত হব না? একজন ধোঁকাবাজ ও প্রতারক ব্যক্তি-পরকাল যার অন্ধকার-হুকুমত দখল করেছে;মু’মিনদের দায়িত্বের বোঝা এমন এক ব্যক্তি কাঁধে তুলে নিয়েছে যে কখনই তাদের প্রতি দয়া দেখায় না।

আমাদের ও তার মাঝে যে বিরোধ দেখা দিয়েছে সে ব্যাপারে আল্লাহ্ তা‘আলাই সর্বোত্তম ফয়সালাকারী;তিনিই তার সাথে আমাদের লড়াইয়ের ফয়সালা করে দেবেন।

হে আল্লাহ্! তুমি আমাদের কাজকর্ম সম্বন্ধে অবগত;তুমি জান যে,আমরা যা বলছি তা না কর্তৃত্ব ও শাসনক্ষমতা হস্তগত করার জন্য,না কারও প্রতি শত্রুতা ও ঈর্ষা চরিতার্থ করার জন্য;বরং (আমাদের সংগ্রাম এজন্য যে,)যাতে তোমার পতাকাকে উড্ডীন করতে পারি,তোমার বান্দাদের ভূখণ্ডকে আবাদ করতে পারি,যালেম ও নিপীড়কদের হাত থেকে তোমার বান্দাদের নিরাপদ করতে পারি,আর (সমাজের বুকে) তোমার আহকাম,সুন্নাত ও ফরযগুলোকে বাস্তবায়ন করতে পারি। তুমি যদি আমাদের সাহায্য না কর তাহলে যালেম ও নিপীড়ক গোষ্ঠী বিজয়ী হবে এবং তোমার নবী-রাসূলগণের নূরকে নির্বাপিত করে ফেলবে।

আল্লাহ্ই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং আমরা তাঁরই ওপর ভরসা করি,আর তাঁর পথেই আমরা চলব এবং তাঁর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন।(তুহাফুল ‘উকূল)

আমীর মুআবিয়ার মৃত্যু ও ইয়াযীদের বাইআত দাবি

৬০ হিজরির রজব মাসে মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের মৃত্যুর পর ইয়াযীদ (তার ওপর আল্লাহর লা`নত) দামেশকের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়। সে ক্ষমতায় বসেই্ মদীনার প্রশাসক ওয়ালীদকে এক পত্র মারফত মদীনাবাসীর,বিশেষ করে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বাই‘আত আদায়ের জন্য নির্দেশ দেয়। ইয়াযীদ তার পত্রে মদীনার প্রশাসককে এ মর্মে আদেশ দেয় যে,হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত হতে অস্বীকৃতি জানালে যেন তাঁকে হত্যা করা হয় এবং তাঁর মাথা দামেশকে ইয়াযীদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ইয়াযীদের নিকট থেকে পত্র পাওয়ার পর ওয়ালীদ বনি উমাইয়্যার বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি মারওয়ান বিন হাকামকে ডেকে পাঠায় এবং হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ব্যাপারে করণীয় সম্বন্ধে তার সাথে পরামর্শ করে। মারওয়ান বলে : ‘সে বাই‘আত হতে রাযী হবে না;তোমার জায়গায় আমি হলে তার শিরচ্ছেদ করতাম।’

ওয়ালীদ বলল : ‘হায়! আমার যদি আদৌ জন্ম না হত!’এরপর সে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠায়।

ইমাম হুসাইন (আ.) বনি হাশিমের ত্রিশ জন লোক ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের সাথে নিয়ে ওয়ালীদের কাছে এলেন। ওয়ালীদ তাঁকে আমীর মু‘আবিয়ার মৃত্যুর সংবাদ জানাল এবং তাঁকে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত হওয়ার জন্য বলল।

ইমাম হুসাইন (আ.) জবাব দিলেন : ‘হে আমীর (প্রশাসক)! বাই‘আত তো আর গোপনে হয় না। তুমি যখন জনসাধারণকে বাই‘আতের জন্য ডাকবে তখন তাদের সাথে আমাকেও ডেক।’

তখন মারওয়ান ওয়ালীদকে বলল : ‘হে আমীর! তার এ ওযর গ্রহণ কর না;বাই‘আত না হলে তার শিরচ্ছেদ কর।’

এ কথায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি বললেন : ‘ওহে বদকার নারীর পুত্র! তুই ধ্বংস হ। তুই বলছিস্ যে,আমার শিরচ্ছেদ করবে? মিথ্যা বলেছিস এবং লাঞ্ছিত হয়েছিস।’

এরপর তিনি ওয়ালীদের দিকে ফিরে বললেন : ‘হে আমীর! আমরা নবুওয়াতের আহলে বাইত এবং রিসালাতের খনি যাদের কাছে ফেরেশতারা আসা-যাওয়া করে। আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টিলোকের অস্তিত্বদান আমাদের মাধ্যমে শুরু করেছেন এবং আমাদের মাধ্যমেই একে সমাপ্তিতে পৌঁছাবেন। অন্যদিকে ইয়াযীদ হচ্ছে এক ফাসেক লোক;সে মদ্যপায়ী এবং সম্মানিত লোকদের হত্যাকারী। সে প্রকাশ্যেই পাপ কাজ করে থাকে। সে এ পদের (খেলাফতের) জন্য উপযুক্ত নয়। আমার মত ব্যক্তি এ ধরনের কোন লোকের অনুকূলে বাই‘আত হতে পারে না। তবে আমি আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব যাতে এ ব্যাপারে তুমিও চিন্তা করে দেখতে পার এবং আমরা সকলেও চিন্তা করে দেখতে পারি যে,আমাদের মধ্য থেকে কোন্ ব্যক্তি খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার ও বাই‘আত লাভের জন্য অধিকতর উপযুক্ত।’

এ সময় মারওয়ান ওয়ালীদকে বলল : ‘তুমি আমার কথার বিরোধিতা করলে।’

ওয়ালীদ বললো : ‘আফসোস্ তোমার জন্য,হে মারওয়ান! তুমি আমাকে আমার দীন ও দুনিয়া উভয়টিই ধ্বংস করতে বলছ। আল্লাহর শপথ,আমি সারা দুনিয়ার ধনসম্পদের মালিক হওয়ার বিনিময়েও হুসাইনের হত্যাকারী হতে চাই না। আল্লাহর শপথ,আমার মনে হয় না যে,এমন একজন লোকও পাওয়া যাবে যে ব্যক্তি হুসাইনের রক্তে তার হাত রঞ্জিত অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে প্রস্তুত হবে,যদি না তার আমলের পরিমাণ এতই হাল্কা হয় যে,কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করবেন না ও তাকে পবিত্র করবেন না;বরং তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অপেক্ষা করতে থাকবে।’

বর্ণনাকারী বলেন : ‘ঐ রাত পার হয়ে গেলে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) খবর জানার জন্য প্রত্যুষে তাঁ র ঘর থেকে বের হলেন। পথে মারওয়ানের সাথে তাঁর দেখা হল। মারওয়ান ইমাম হুসাইনকে বলল : ‘হে আবা আবদিল্লাহ্! আমি তোমার খবর জানতে চাই;তুমি আমার কথা শোন যাতে সঠিক পথ পেতে পার।’

ইমাম হুসাইন বললেন : ‘আগে শুনি তুমি কী বলতে চাও।’

মারওয়ান বলল : ‘আমার প্রস্তাব হচ্ছে এই যে,তুমি যদি আমীরুল মু’মিনীন ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত হও তাহলে তা তোমার দীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক।’

জবাবে ইমাম হুসাইন বললেন : ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘উন্। উম্মাহ্ যখন ইয়াযীদের ন্যায় শাসকের কবলে পড়ে তখন ইসলামকে বিদায়! আর আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছি,তিনি এরশাদ করেছেন : আবু সুফিয়ানের পরিবারের জন্য খেলাফত হারাম।’

হযরত ইমাম হুসাইন ও মারওয়ানের মধ্যকার কথোপকথন অনেকক্ষণ যাবৎ চলল। শেষ পর্যন্ত মারওয়ান ক্রুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

মক্কাত্যাগকালীন ভাষণ

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারায় রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে পরিবার-পরিজন ও ভক্ত-অনুরক্তদের নিয়ে মদীনা ছেড়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে চলে যান এবং মসজিদে হারামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে থাকাকালে তাঁকে কুফায় গিয়ে বিপ্লবে নেতৃত্বদানের জন্য কুফাবাসীর পক্ষ থেকে দাওয়াত আসতে থাকে। ইতিমধ্যে যখন তিনি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পারলেন যে,ইয়াযীদ হজ্বের সময় লোকজনের ভীড়ের মধ্যে তাঁকে হত্যা করার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠিয়েছে,তখন পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে তিনি হজ্বের আগের দিন আটই যিলহজ্ব প্রত্যুষে কুফার উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করেন। এর আগের রাতে তিনি তাঁর কাছে সমবেত তাঁর কতক বন্ধুবান্ধব,পরিবারের সদস্য,সঙ্গীসাথী,অনুসারী ও উপস্থিত জনতার উদ্দেশে নিম্নোক্ত ভাষণ প্রদান করেন :

‘সকল প্রশংসা কেবল আল্লাহর জন্য। তিনি যা চাইবেন তা-ই হবে। তাঁর সম্মতি ছাড়া কারও পক্ষেই কোন কাজ সম্পাদন করা সম্ভব নয়। প্রশংসা আল্লাহর এবং তাঁ র রাসূলের ওপর দরূদ বর্ষিত হোক। আদম-সন্তানদের গলায় মৃত্যুর দাগ কেটে দেওয়া হয়েছে (অবধারিত করে দেওয়া হয়েছে) যেভাবে যুবতীদের গলায় হারের দাগ কেটে থাকে। ইয়াকুব (আ.) যেভাবে ইউসুফ (আ.)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ঠিক সেভাবেই আমি আমার পূর্ববর্তী পুণ্যবানদের সাথে সাক্ষাতের আশা পোষণ করি। আর যে জায়গা আমার শাহাদাত্গাহ্ হবে এবং আমার লাশ গ্রহণ করবে সে জায়গা আমার জন্য পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাকে এখন সেখানে পৌঁছতে হবে। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি,কারবালার নাওয়াভীসে (কারবালার নিকটবর্তী একটি গ্রাম;হুর বিন ইয়াযীদের কবর সেখানে অবস্থিত।)মরুভূমির নেকড়েরা আমার শরীর ছিন্নভিন্ন করছে এবং তাদের শূন্য উদর ভর্তি করছে। আর কোন মানুষের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা যাতে সন্তুষ্ট,আমরা রিসালাতের পরিবারও তাতেই সন্তুষ্ট। এ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে পরীক্ষা;আমি এ পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণ করব। আর ধৈর্যশীলদের প্রতিদান পরম দাতা আল্লাহ্ তা‘আলার হাতে। যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর সাথে আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক রাখে তারা তাঁর থেকে পৃথক হবে না এবং বেহেশ্তে তাঁর সমীপে থাকবে,আর তাদের দর্শনে আল্লাহ্ তা‘আলার মহান রাসূলের নয়নদ্বয় উজ্জ্বল হবে।

আমি প্রত্যুষে রওনা হব,ইনশা আল্লাহ্। 

(সূত্র: প্রত্যাশা, বর্ষ ১,সংখ্যা ৩)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

১০ ই মহররমের স্মরণীয় কিছু ঘটনা ও ...
আত্মগঠনের মাস : রমযান
দুঃখ-কষ্ট মোকাবেলার উপায়
পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণ
রজব মাসের ফজিলত ও আমলসমূহ
তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন
শাবে জুম্মা
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?

 
user comment