বাঙ্গালী
Friday 22nd of November 2024
0
نفر 0

শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ- ১ম পর্ব

শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ- ১ম পর্ব

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মানুষ তার স্বজাতীয় লোকদের সাথে সমাজবদ্ধ হয়ে একসংগে জীবন যাপন করে। মানুষ তার জীবনে সামাজিক পরিবেশে যে সব কাজ করে, সে সকল কাজ পরস্পর সম্পর্কহীন নয়। যেমনঃ মানুষের খাওয়া, পড়া, পান করা, চলা, ঘুমানো, জাগ্রত হওয়া, পরস্পরের সাথে মেলা মেশা ইত্যাদি কাজ বাহ্যতঃ পরস্পর সম্পর্কহীন বলে মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে এগুলো সম্পূর্ণ রূপে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত । যে কোন কাজই ইচ্ছেমত যত্র-তত্র ও যখন ইচ্ছে তখন করা যায় না। বরঞ্চ যে কোন কাজের জন্যেই একটি নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন রয়েছে। তাই মানুষ তার জীবনের প্রয়োজনীয় কাজ-কর্মগুলো সুনির্দিষ্ট একটি নিয়মতান্ত্রিকতার অধীনে সম্পন্ন করে, যা কখনই ঐ নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয় না। আর মানব জীবনে সম্পাদিত সকল কাজের উদ্দেশ্যই বিশেষ একটি বিন্দু থেকে উৎসারিত। আর সেই কেন্দ্র বিন্দুটি হল, মানব জীবনের সাফল্য ও সৌভাগ্র লাভের আকাংখা, অর্থাৎ মানুষ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যে তার অভাব ও প্রয়োজন গুলোকে যথাসম্ভব পূর্ণ করার আকাংখা পোষণ করে।

এ কারণেই মানুষ তার জীবনের সকল কাজকর্মকে তার স্বরচিত নিজের ইচ্ছেমত রচিত আইন বা অন্যের কাছ থেকে গৃহীত আইনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে। এ ভাবে সে আপন জীবন যাপনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করে। তাই জীবন যাপনের স্বার্থে সে প্রয়োজনীয় জীবন উপকরণ সংগ্রহের জন্যে আত্মনিয়োগ করে। কেননা, সে বিশ্বাস করে জীবন উপকরণ সংগ্রহ জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় একটি বিধান। সে রসনার তৃস্তি সাধান এবং ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে খাদ্য ও পানি পান করে থাকে। কেননা, সে সৌভাগ্যপূর্ণভাবে বেচে থাকার জন্যে খাওয়া ও পান করাকে সে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। ঠিক এভাবেই সে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের লক্ষে পূর্বনির্ধারিত কিছু নিয়ম মেনে চলে।

মানব জীবনের উপর প্রভুত্ব বিস্তারকারী উল্লিখিত বিধি বিধানের ভিত্তিমূল একটি বিশেষ মৌলিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর তার উপরই মানব জীবন নির্ভরশীল।

মানুষ এই সৃষ্টি জগতেরই একটি অংশ বিশেষ এবং সমগ্র সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের মূলরহস্য সম্পর্কে প্রতিটি মানুষেরই একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা বা বিশ্বাস রয়েছে। সৃষ্টি জগতের রহস্য সম্পর্কে মানুষের চিন্তা-ভাবনা বা ধারণার প্রকৃতি কেমন হতে পারে, একটু চিন্তা করলেই তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেমন-যারা এ সৃষ্টি জগতকে শুধুমাত্র জড় বা বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে এবং মানুষকেও সস্পূর্ণরূপে (১০০%) জড় অস্তিত্ব (জন্মের মাধ্যমে জীবনের সূচনা এবং মৃত্যুর মাধ্যমে তার ধ্বংস) বলে বিশ্বাস করে, তাদের অনুসৃত জীবন পদ্ধতিও জড়বাদের উপর ভিত্তি করেই রচিত। অর্থাৎ স্বল্পকালীন এ পার্থিব জীবনের স্বাদ উপভোগই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আর এ জন্যেই সমগ্র বিশ্বজগৎ ও প্রকৃতিকে বশে আনার জন্যে তারা তাদের জীবনের সকল প্রচেষ্টা ও সাধানা বিনিয়োগ করে।

আবার অনেকেই (মূর্তি উপাসকরা) এ বিশ্ব জগৎ ও প্রকৃতিকে তার চেয়ে উচ্চতর ও মহান এক অস্তিত্বের (আল্লাহ) সৃষ্টিকর্ম বলে বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে মহান আল্লাহ মানুষকে তার অসংখ্য অনুগ্রহ মূলক দান ও নেয়ামতের মাঝে নিমজ্জিত রেখেছেন, যাতে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত অসীম অনুগ্রহ উপভোগ করে উপ্রকৃত হতে পারে। সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের রহস্য সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাসের অধিকারী ব্যক্তিগণ এমন এক জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করেন, যার মাধ্যমে সর্বস্রষ্টা আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জন করা এবং তার ক্রোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কেননা, যদি তারা মহান আল্লাহর সন্তষ্টি লাভ করতে সমর্থ হন, তাহলে তিনি তাদের প্রতি তার অনুগ্রহের পরিমাণ বাড়িয়ে দিবেন এবং তাদেরকে অসীম ও চিরন্তন অনুগ্রহ বা নেয়ামতের অধিকারীও করবেন। আর মানুষ যদি তার কৃতকর্মের মাধ্যমে মহান স্রষ্টার ক্রোধের সঞ্চার করে, তাহলে তারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ বা নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে।

অন্য দিকে যারা শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছাড়াও মানুষের জন্যে এক অনন্ত জীবনে বিশ্বাসী, এবং মানুষকে তার পার্থিব জীবনের কৃত সকল ভাল ও মন্দ কাজের জন্যে দায়ী বলে বিশ্বাস করে। ফলে তারা কেয়ামত দিনের প্রতিও বিশ্বাসী, যে দিন মানুষকে তার ভাল মন্দ সব কাজের জবাবদিহি করতে হবে এবং ভাল কাজের জন্যে পুরস্কৃত করা হবে; এই কেয়ামতের দিনকে ইহুদী, খৃষ্টান, মাজুসী এবং মুসলমানরা ও বিশ্বাস করে। এ ধরণের বিশ্বাসের অধিকারী ব্যক্তিরা এমন এক জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করে যা ঐ মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জশ্যপূর্ণ এবং মানুষের ইহকাল ও পরকালীন উভয় জীবনেই সৌভাগ্যবান হওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে। এ বিশ্ব জগতের সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কিত মৌলিক বিশ্বাসসমহূ এবং তার ভিত্তিতে রচিত অনুকরণীয় জীবন পদ্ধতির নীতিমালা সমষ্টির অপর নামই ‘দ্বীন’। ‘দ্বীনের’ মধ্যে সৃষ্ট শাখা সমূহকে ‘মাযহাব’ বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ যেমন : আহলুস সুন্নাহ ও আহলুস তাশাইয়ূ ইসলামের অন্যতম দু‘টি মাযহাব এবং খৃষ্টান ধর্মের মালেকানী ও নাসতুরী মাযহাবদ্বয়।

ইতিপূর্বের আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে, মানুষ দ্বীনের (এক শ্রেণীর মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত জীবন পদ্ধতি) প্রতি নির্ভরশীলতা থেকে (যদি সে আল্লাহতে বিশ্বসী নাও হয়) আদৌ মুক্ত নয়। সতরাং ‘দ্বীন’ মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় এমন এক জীবন পদ্ধতি, যা মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ স্বরূপ। পবিত্র কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী ‘দ্বীন’ কে এড়িয়ে যাওয়া মানুষের জন্যে অসম্ভব। এটা এমন এক পথ যা স্বয়ং মহান আল্লাহ মানব জাতির প্রতি প্রসারিত করেছেন এবং মহান আল্লাহতে গিয়েই এ পথের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। অর্থাৎ সত্য ‘দ্বীন’ (ইসলাম) গ্রহণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথেই ধাবিত হয়। আর যারা সত্য ‘দ্বীন’কে গ্রহণ করেনি প্রকৃতপক্ষে তারা ভ্রান্ত পথই অনুসরণ করেছে এবং পথভ্রষ্ট হয়েছে।

ইসলাম : আত্মসমর্পণ ও মাথানত কুরাই ‘ইসলাম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ । পবিত্র কুরআনে যে ‘দ্বীন’ অনুসরণের প্রতি মানব জাতিকে আহবান্ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘ইসলাম’। ইসলাম নাম করণের মূল কারণ হচ্ছে, সমগ্র বিশ্ববাসী একমাত্র মহান আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসর্মপণ করবে। এই আত্মসমর্পণের ফলশ্রুতিতে সে এক আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত অন্য কারো নির্দেশের আনুগত্য করবে না এবং একমাত্র তারই উপাসনা ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা করবে না। আর এটাই হল ইসলামের মূল কর্মসূচী । পবিত্র কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি এই ‘দ্বীন’ কে ইসলাম’ ও এর অনুসারীদেরকে ‘মুসলমান’ হিসেবে নাম করণ করেন, তিনি হলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.)।

শীয়া : ‘শীয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল অনুসারী । যারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারকে তার প্রকৃত ও একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য করেন, তারাই ‘শীয়া’ নামে পরিচিত। তারা ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর আদর্শের অনুসারী।

শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও তার বিকাশ পক্রিয়া

সর্বপ্রথম যারা ‘শীয়াতু-আলী’ বা হযরত আলী (আ.) [পবিত্র আহলে বাইতের (আ.) ইমামদের প্রথম ইমাম]-এর অনুসারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল, তাদের আবির্ভাব মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই ঘটেছিল। মহানবী (সা.)-এর দীর্ঘ ২৩ বছর যাবৎ নবুয়ত কাল ইসলামের আবির্ভাব, প্রচার ও অগ্রগতির ঘটনা অনেক উপলক্ষ্য বা হেতুর সৃষ্টি করেছিল। ঐসব উপলক্ষ্য বা হেতুগুলোই রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মাঝে এ ধরণের একটি সম্প্রদায়ের (শীয়া) আবির্ভাব ঘটিয়ে ছিল।

১. নবুয়ত প্রাপ্তির প্রথম দিনগুলোতে মহানবী (সা.) পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম নিকটআত্মীয়দের কাছে ইসলাম প্রচারের জন্যে আদিষ্ট হয়েছিলেন। তখন তিনি স্পষ্টভাবে তাদেরকে আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম আমার আহবানে সাড়া দিবে, সেই হবে আমার প্রতিনিধি এবং স্থলাভিষিক্ত ও উত্তরাধিকারী ।” তখন একমাত্র হযরত আলী (আ.)-ই সবার আগে মহানবী (সা.)-এর আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মহানবী (সা.) ও হযরত আলী (আ.)-এর ঈমান আনয়নের বিষয়টিকে স্বাগত জানান এবং তাঁর ব্যাপারে স্বীয় প্রতিশ্রুতিকেও তিনি রক্ষা করেছিলেন। এটা কখনই সম্ভব নয় যে, কোন একটি আন্দোলনের নেতা, আন্দোলনের সূচনা লগ্নে কোন একজন সহযোগীকে তার প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী হিসেবে অন্য সবার কাছে পরিচিত করাবেন, অথচ তার একনিষ্ট ও আত্মত্যাগী সহযোগীদের কাছে তাকে তিনি পরিচিত করাবেন না। অথবা তাকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে পরিচিত করাবেন, কিন্ত তার সমগ্র জীবদ্দশায় তাকে তার দায়িত্ব থেকে অপ্রসারণ করবেন, তার স্থলাভিষিক্তের পদমর্যাদাকে উপেক্ষা করবেন এবং অন্যান্যদের সাথে কোন পার্থক্যই রাখবেন না।

১. শীয়া ও সুন্নী উভয় সূত্রে বর্ণিত অসংখ্য ‘মুতাওয়াতির’ ও ‘মুস্তাফিজ’ হাদীসে মহানবী (সা.) স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত আলী (আ.) তার কথায় ও কাজে ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত। তিনি যা কিছু বলেন এবং করেন, সবই ইসলামের প্রচার কাজের সাথে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ । ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শরীয়তের ক্ষেত্রে তিনিই সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি।

২. হযরত আলী (আ.) ইসলামের জন্যে অতীব মূল্যবান সেবামুলক কাজ করেছেন। ইসলামের পথে তিনি আশ্চর্যজনক আত্মত্যাগের প্রমাণ রেখেছেন। উদাহরণ স্বরূপ মদীনায় হিজরতের রাতে মহানবী (আ.)-এর বিছান্যায় শয়ন, বদর, ওহুদ, খন্দক ও খায়বারের যুদ্ধ তার দ্বারা অর্জিত বিজয়সমূহ উল্লেখযোগ্য। এ সব ঘটনার কোন একটিতেও যদি তিনি উপস্থিত না থাকতেন তাহলে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ্ সেদিন আল্লাহর শত্রুদের হাতে ধ্বংস হয়ে যেত।১০

৩. ‘গাদিরে খুমের ঘটনা’, এ ঘটনায় মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে জনসাধারণের মাঝে তাদের গণনেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ও পরিচিত করিয়ে দেন। তিনি আলী (আ.)-কে নিজের মতই জনগণের অভিভাবকের পদে প্রতিষ্ঠিত করেন।

৪ হযরত আলী (আ.)-এর এধরণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও মহত্বের অধিকারী হওয়ার বিষয়টি ছিল একটি সর্বসম্মত ব্যাপার১১। এ ছাড়াও তাঁর প্রতি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ভালবাসা ছিল অপরিসীম।১২ সব মিলিয়ে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল যে, সত্য ও মহত্বের অনুরাগী রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবী আলী (আ.)-এর প্রেমে অনুরক্ত ও তার অনুসারীতে পরিণত হবেন। একইভাবে এ বিষয়টি বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবীর ঈর্ষা ও বিদ্বেষের কারণও ঘটিয়েছিল, যা তাদেরকে আলী (আ.)-এর প্রতি শত্রুতায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ সকল বিষয় ছাড়াও স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পবিত্র বাণীসমূহে “শীয়াতুআলী [আলী (আ.)-এর অনুসারী] এবং ‘শীয়াতু আহলুল বাইত’ (পবিত্র আহলে বাইতের অনুসারী) নামক শব্দগুলোর বহুল ব্যাবহার পরিলক্ষিত হয়।১৩

সুন্নী জনগোষ্ঠী থেকে শীয়া জনগোষ্ঠীর পৃথক হওয়ার কারণ

রাসূল (সা.) সাহাবাবৃন্দ এবং মুসলমাদের কাছে হযরত আলী (আ.) উচ্চমর্যাদার অধিকারী ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই হযরত আলী (আ.)-এর ভক্ত ও অনুসারীদের এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, মহানবী (সা.)-এর তিরোধনের পর মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব ও খেলাফতের অধিকার একমাত্র হযরত আলী (আ.)-এর-ই-রয়েছে। আর রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুপূর্ব অসুস্থ অবস্থার সময়ে সংঘটিত কিছু ঘটনা ছাড়া অন্য সকল ঘটনা প্রবাহ তাদের এ ধারণারই সাক্ষ্য দিচ্ছিল।১৪

কিন্ত পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পূর্ণরূপে তাদের ধারণার বিপক্ষে বইতে শুরু করল। আর এটা তখনই ঘটল, যখন বিশ্বনবী (সা.) সবেমাত্র শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার পবিত্র দেহ এখনও দাফন হয়নি। রাসূল (সা.)-এর শোকগ্রস্থ পবিত্র আহলে বাইত (আ.) ও কিছু সংখ্যক সাহাবী যখন রাসূল (সা.)-এর দাফন কাফনের আয়োজনে ব্যস্ত, ঠিক তখনই খবর এল, কিছু সংখ্যক সাহাবী খলিফা নির্বাচন করে ফেলেছেন। খলিফা নির্বাচনের ঘটনা এত দ্রুত ও তাড়াহুড়ার মধ্যে ঘটানো হয়েছিল যে, এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর পবিত্র আহলে বাইত (রাসূলের পরিবার), আত্মীয় স্বজন এবং ভক্ত ও অনুসারীদেরকে পরামর্শের জন্যেও কোন প্রকারে সংবাদ দেয়া হয়নি। এ ঘটনার মূল ব্যক্তিরা পরবর্তীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও প্রথম অবস্থায় এদের সংখ্যা ছিল খুবই নগন্য। অথচ তারা বাহ্যত মুসলমাদের কল্যাণকামীতার দাবিদার ছিল। এ ভাবেই হযরত আলী (আ.) ও তার অনুসারীরা এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখী হলেন।১৫

হযরত সালমান ফারসী, হযরত মিকদাদ, হযরত আবুযার, হযরত আব্বাস, হযরত যুবাইর, হযরত আম্মারসহ হযরত আলী (আ.) ও তার অন্যান্য অনুসারীরা রাসূল (সা.)-এর দাফন কাফনের অনুষ্ঠান শেষ করা এবং খলিফা নির্বাচনের ঘটনা সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত হওয়ার পর এ ব্যাপারে তারা কঠোর সমালোচনা করেন। এ ছাড়াও তথাকথিত নির্বাচিত খলিফা এবং এ ঘটনার মূল ব্যক্তিদের কাছে এ ব্যাপারে তারা ব্যাপক প্রতিবাদ জানান। এমন কি এ ব্যাপারে তারা কিছু গণজমায়েতও করেন। কিন্ত এর উত্তরে তাদেরকে বলা হয়, এ ঘটনাকে মেনে নেয়ার মাঝেই মুসলমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।১৬

প্রতিষ্ঠিত খলিফার প্রতি সমালোচনা ও বিরুদ্ধাচারণই হযরত আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদেরকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়ার কারণ ঘটিয়ে ছিল। আর তখন থেকেই হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারীরা ‘শীয়াতু আলী’ (আলীর অনুসারী) নামে সমাজে পরিচিতি লাভ করে। অবশ্য খলিফার প্রশাসনিক অঙ্গনে এমন এক সতর্কপূর্ণ প্রচেষ্টা ছিল যে, আলী (আ.)-এর অনুসারীরা এভাবে বিশেষ একটি নামে সমাজে পসিদ্ধি লাভ না করুক। মুসলিম সমাজ এভাবে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দু‘টি দলে বিভক্ত না হোক। বরং তাদের প্রচেষ্টা ছিল খেলাফতকে একটি সর্বসম্মত বিষয় হিসেবে সমাজের কাছে তুলে ধরা। তাই খেলাফতের বিরোধীদেরকে তারা ‘বাইয়াতের’ বিরোধী ও মুসলিম উম্মার বিরোধী হিসেবে সমাজে পরিচিতি করাতে খাকলেন। কখনও বা খেলাফতের বিরোধীদেরকে এর চেয়ে জঘণ্য ভাষায় সম্বোধন করা হত।১৭

অবশ্য শীয়াদেরকে সেদিন তাদের জন্ম লগ্নেই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা পদদলিত হতে হয়েছিল। শুধুমাত্র মৌখিক প্রতিবাদ-কর্ম সূচীর মাধ্যমে তারা একপাও অগ্রসর হতে পারেনি। আর হযরত আলী (আ.) ইসলাম ও মুসলমাদের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা এবং প্রয়োজনীয় শক্তি সামর্থের অভাবে একটি রক্তক্ষয়ী বিপ্লব থেকে বিরত রইলেন। কিন্ত খেলাফত বিরোধী পক্ষ তাদের মতাদর্শের ব্যাপারে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকার ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের ব্যাপারে তারা একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-কেই যোগ্য বলে বিশ্বাস করতেন।১৮ তারা জ্ঞানগত ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের গুণাবলী একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর মধ্যেই দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তারা তাঁর দিকেই মুসলমানদেরকে আহবান জানাতেন।১৯

রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকার ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের বিষয়

ইসলামের শিক্ষা থেকে শীয়ারা যে জ্ঞান লাভ করেছিল, তাতে শীয়ারা বিশ্বাস করত যে, যে বিষয়টি সমাজের জন্যে সর্বপ্রথম জরুরী তা হল, ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সবার সুস্পষ্ট ধারণার অধিকারী হওয়া।২০ আর পরবর্তী পর্যায়ে সেই ইসলামী শিক্ষা সমূহকে পূর্ণ ভাবে সমাজে প্রয়োগ করা। অন্য কথায়,

প্রথমতঃ সমাজের প্রত্যেককেই এ পৃথিবী ও মানব জাতিকে বাস্তব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে একজন মানুষ হিসেবে নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে অবগত এবং তা পালনে ব্রত হওয়া উচিত। এমন কি তা যদি তার ইচ্ছার বিরোধীও হয় তবুও তা পালন করা উচিত।

দ্বিতীয়তঃ একটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সমাজে ইসলামের প্রকৃত বিধি বিধান সমূহকে সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করবে। যাতে করে ঐ সমাজের কেউই যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা না করে এবং সবাই পূর্ণ স্বাধীনতাসহ ব্যক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার ভোগ করতে পারে। আর এদু‘টি মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে এমন এক ব্যক্তির প্রয়োজন, যে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিস্পাপ হওয়ার মত গুণের অধিকারী হবে। অন্যথায় হয়ত এমন কোন লোক সেই শাসন ব্যবস্থা ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের আসনের অধিকারী হয়ে বসবে, যে তার ঐ গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চিন্তাগত পথভ্রষ্টতা বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভবনা থেকে মুক্ত নয়। এর ফলে তখন ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা ব্যহত হবে ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা একটি অত্যাচারী একনায়েক বা রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে। তখন ইসলামের পবিত্র জ্ঞানভান্ডার পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মতই স্বেচ্ছাচারী ও স্বার্থান্বেষী পণ্ডিত মহলের দ্বারা বিকৃতির স্বীকার হবে। বিশ্বনবী (সা.)-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী একমাত্র যে ব্যক্তি কথায় ও কাজে এ পদের জন্যে উপযুক্ত ছিল এবং যার পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুরূপ ছিল, তিনি হচ্ছেন হযরত আলী (আ.)।২১

যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল এই যে, ‘কুরাইশরা’ খেলাফতের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির বিরোধী। তারপরও তাদের উচিত ছিল বিরোধীদেরকে সত্যের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য করা এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করা। ঠিক যেমনটি যাকাত প্রদান অস্বীকারকারীদের সাথে করা হয়েছিল। এমনকি তাদের সাথে যুদ্ধও করা হয়েছিল। তবুও যাকাত আদায় থেকে তারা বিরত হয়নি। তাই কুরাইশদের বিরোধীতার ভয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে হাত গুটিয়ে সত্রক হত্যা করা তাদের কখনও উচিত হয়নি। নির্বাচিত খেলাফতকে সম্মতি প্রদান থেকে যে কারণটি শীয়াদের বিরত রেখে ছিল, তা হচ্ছে এ ঘটনার অনাকাংখিত পরিণতি, যা ইসলামী শাসন ব্যবস্থার জন্যে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসত এবং ইসলামের সুমহান শিক্ষার ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিত। বাস্তবিকই পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ক্রমেই এ ধারণার সত্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। এর ফলে শীয়াদের এ সংক্রান্ত বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হতে থাকে। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে শীয়ারা বাহ্যত হাতে গানা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যা বৃহত্তর জননমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল, তথাপি পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) গোপনে ইসলামের শিক্ষাদান কর্মসূচী এবং নিজস্ব পদ্ধতিতে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে নিরন্তন চেষ্টা চালিয়ে যান। অন্যদিকে এর পাশাপাশি ইসলামী শক্তির উন্নতি ও সংরক্ষণের বৃহত্তর স্বার্থে তারা শাসক গোষ্ঠির সাথে প্রকাশ্যে বিরোধীতা থেকে বিরত থাকেন। এমন কি শীয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে সকল জিহাদেরও অংশ গ্রহণ করতেন এবং গণ-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপও করতেন। স্বয়ং হযরত আলী (আ.) ইসলামের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠদের পথ নির্দেশনা দিতেন।২২

নির্বাচিত খেলাফতের রাজনীতি ও শীয়াদের দৃষ্টিভঙ্গী

শীয়া মাযহাবের অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, ইসলামের ঐশী আইন বা শরীয়ত, যার উৎস পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা.)-এর সুন্নাত তা কেয়ামত পর্যন্ত সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন ও অপরিবর্তীত অবস্থায় এবং স্বীয় মর্যাদায় টিকে থাকবে।২৩ ইসলামী আইনসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে এতটকু টাল-বাহানা করার অধিকার ইসলামী সরকারের নেই। ইসলামী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে পরামর্শ সভার পরামর্শ ও সমসামায়িক পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামী শরীয়তের (আইন) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কিন্ত রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু পুর্ব অসুস্থ অবস্থার সময়ে সেই ঐতিহাসিক ‘কাগজ কলম আনার ঘটনা’ খলিফা নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাইয়াত গ্রহণসহ ইত্যাদি ঘটনা তদানিন্তন খেলাফতের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তোলে। এ ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে যায় যে, নির্বাচিত খেলাফতের মূল ব্যক্তিবগ ও সমর্থকগণ পবিত্র কুরআনকে কেবল মাত্র একটি সংবিধান হিসাবে সংরক্ষণে বিশ্বাসী। কিন্তু রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত ও আদর্শকে তারা অপরিবর্তনীয় বলে মনে করত না। বরং তাদের ধারণা ছিল ইসলামী সরকার নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত বাস্তবায়ন থেকেও বিরত থাকতে পারে। তদানিন্তন খেলাফততন্ত্রের এ দৃষ্টি ভঙ্গীর প্রমাণ পরবর্তীতে রাসূল (সা.)-এর বহু সাহাবীদের কথা ও কাজে পরিলক্ষিত হয় (সাহাবীরা মুজতাহিদ। ইজতিহাদ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি সত্যে উপনীত হন, পুরস্কৃত হবেন। আর যদি ভুল করেন, ক্ষমা প্রাপ্ত হবেন)। এর স্পষ্ট উদাহরণ জনৈক সাহাবী ও সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের ঐতিহাসিক ঘটনায় পাওয়া যায়। কোন এক রাতে খালিদ বিন ওয়ালিদ জনাব মালিক বিন নুওয়াইরা নামক জনৈক গণ্যমান্য মুসলমানের বাড়িতে আকস্মিকভাবে অতিথি হন। খালিদ বিন ওয়ালিদ তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে হত্যা করেন এবং তাঁর কর্তিত মাথা চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন।

অতঃপর ঐ রাতেই নিহতের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন। কিন্তু, সামরিক বাহিনীর জন্যে খালিদ বিন ওয়ালিদের মত সুযোগ্য সেনাপতির প্রয়োজন। এই স্বার্থে খলিফা এ ধরণের জঘণ্য ও নৃশংস হত্যা কান্ডের বিচার ও প্রয়োজনীয় শাস্তি, খালিদ বিন ওয়ালিদের উপর প্রয়োগ থেকে বিরত খাকলেন।২৪ একইভাবে খলিফার প্রশাসন মহানবী (সা.)-এর আত্মীয়- স্বজন ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি নিয়মিত প্রদত্ত খুমস্ বন্ধ করে দেন।২৫ রাসূল (সা.)-এর হাদীস লেখা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যদি কখনও লিপিবদ্ধ কোন হাদীস কোথাও কারো কাছে পাওয়া যেত তাহলে সাথে সাথেই তা বাজেয়াপ্ত করা হত এবং পুড়িয়ে ফেলা হত।২৬ হাদীস লিপিবদ্ধকরণ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি সমগ্র ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের’ যুগে অব্যাহত ছিল। আর তা উমাইয়া খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের শাসন আমলে (হিঃ ৯৯ - ১০২ হিঃ) পর্যন্ত বলবৎ থাকে।২৭ দ্বিতীয় খলিফা ওমরের সময় (হিঃ ১৩ - ২৫ হিঃ) খেলাফত প্রশাসনের এ রাজনৈতিক পদক্ষেপটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ সময় দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইসলামী শরীয়তের বেশ কিছু আইনের পরিবর্তন সাধান করেন। যেমন : ‘হজ্জে তামাত্তু’ ‘মুতা বিবাহ্ এবং আযান’ এ ‘হাইয়্যা আলা খায়রিল আমাল’ ব্যাক্যটির ব্যাবহার তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনিই একই বৈঠকে তিন তালাকসহ এজাতীয় আরো অনেক নীতির প্রচলন শুরু করেন।২৮

দ্বিতীয় খলিফা ওমর সর্বপ্রথম বাইতুল মালের অর্থ জনগণের মধ্যে বন্টনের সময় বৈষম্যেরে সৃষ্টি করেন।২৯ এ বিষয়টি পরবর্তীতে মুসলমাদের মাঝে আশ্চর্যজনক শ্রেণীবৈষম্য এবং ভয়ংকর ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়। দ্বিতীয় খলিফা ওমরের খেলাফতের সময়েই মুয়াবিয়া সিরিয়ায় রাজপাসাদে বসে শাসনকার্য পরিচালনার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সূচনা করেন। দ্বিতীয় খলিফা ওমর তাকে আরবের ‘কাসরা’ (জনৈক বিখ্যাত পারস্য সম্রাটের উপাধি) বা বাদশাহ্ বলে ডাকতেন। তিনি কখনো মুয়াবিয়ার এধরণের কাজের প্রতিবাদ করেননি।

দ্বিতীয় খলিফা ওমর হিজরী ২৩ সনে জনৈক পারসিক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হন। মৃত্যুর পূর্বে খলিফা ওমরের নির্দেশে ৬ সদস্য বিশিষ্ট খলিফা নির্বাচন কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সংখ্যাধিক্যের মতামতের ভিত্তিতে তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন ও তার শাসনভার গ্রহণ করেন। তৃতীয় খলিফা ওসমান তার শাসন আমলে উমাইয়া বংশীয় আপন আত্মীয় স্বজনদের ব্যাপক হারে প্রশাসনে নিযুক্ত করার মাধ্যমে উমাইয়্যাদেরকে জনগণের উপর প্রভুত্ব বিস্তারে সহায়তা করেন। হিজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) ইরাক ও মিশরসহ অন্যান্য ইসলামী প্রদেশগুলোর শাসনভার তিনি উমাইয়া বংশের লোকজনের উপর অর্পন করেন।৩০ এরা সবাই প্রকাশ্যভাবে অন্যায়-অত্যাচার, দূর্নীতি, ইসলামী নীতিমালা লংঘন ও পাপাচার পচলনের মাধ্যমে ইসলামী প্রশাসনে চরম অরাজকতার সূত্রপাত ঘটায়।৩১ তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের চতুর্দিক থেকে জনগণের অভিযোগ ওসমানের কাছে পৌছতে লাগল। কিন্ত খলিফা ওসমান উমাইয়া বংশীয় ক্রীতদাসী এবং বিশেষ করে জনাব মারওয়ান বিন হাকামের (খলিফার চাচাতো ভাই এবং পধানমন্ত্রী) দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন। ফলে জনগণের অভিযোগকে তিনি কখনই গুরুত্ব দিতেন না।

শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে তিনি অভিযোগকারীদের শায়েস্তা করার নির্দেশ জারী করতেন।৩২ অবশেষে হিজরী ৩৫ সনে জনগণ খলিফার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। খলিফা ওসমানের বাড়ী বেশ ক’দিন ঘেরাও রাখা হয় এবং কিছু সংঘর্ষের পর তারা খলিফাকে হত্যা করে। সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক এবং তৃতীয় খলিফা ওসমানের ঘনিষ্ট আত্মীয়। ওসমান তার শাসন আমলে সিরিয়ার প্রশাসনকে অধিক শক্তিশালী করেন। প্রকৃতপক্ষে খেলাফতের গুরুভার ক্রমেই সিরিয়ায় কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। যদিও রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোগত কেন্দ্র ছিল মদীনা। তবে তা একটি বাহ্যিকরূপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।৩৪

ইসলামের প্রথম খলিফা সাহাবীদের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন। দ্বিতীয় খলিফা, প্রথম খলিফার ওসিয়াত নামার মাধ্যমে মনোনয়ন লাভ করে ক্ষমতায় আসেন। আর তৃতীয় খলিফা, দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনিত ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে মনোনীত হন। ঐ কমিটির নির্বাচনের নীতিমালাও পূর্ব থেকেই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। যাই হোক, ইসলামের প্রথম তিন খলিফা, যাদের শাসনকাল পায় পচিশঁ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত রাজনীতির স্বরূপ এটাই ছিল যে, তারা নিজস্ব ‘ইজতিহাদ’(গবেষণা) অনুসারে প্রয়োজনীয় যুগপোযাগী সিদ্ধান্ত নিবেন এবং সমাজে তা প্রয়োগ করবেন। ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রসারের ব্যাপারে তাদের নীতি ছিল এই যে, পবিত্র কুরআন, তাফসির (ব্যাখা) বা গবেষণা ছাড়াই পঠিত হবে। আর রাসূল (সা.) এর হাদীস অলিখিত ভাবে প্রচারিত হবে এবং অবশ্যই তা মৌখিক বর্ণনা ও শবণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। পবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরী করণ অত্যন্ত সীমিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল। আর হাদীস লিখন ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।৩৫ হিজরী ১২ সনে সংঘটিত ‘ইয়ামামা’র যুদ্ধ পর্যন্ত এ অবস্থা বলবৎ ছিল। ঐ যুদ্ধে বেশ কিছু সাহাবী নিহত হন যারা কুরআনের কারী ও হাফেজ ছিলেন। তখন দ্বিতীয় খলিফা ওমর, প্রথম খলিফা আবুব বকরকে সমগ্র কুরআনকে গ্রন্থবদ্ধ আকারে এক যায়গায় সংগৃহীত করার জন্য প্রস্তাব দেন। দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব বলেন, ভবিষ্যতে যদি এ ভাবে কুরআনের আরও হাফিজ নিহত হন, তাহলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আর কুরআনের অস্তিত থাকবে না। সুতরাং কুরআনের সব আয়াতগুলো এক যায়গায় সংগ্রহ করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন।৩৬

এ সিদ্ধান্ত শুধু কুরআনের ক্ষেত্রেই গৃহীত হয়। অথচ রাসূল (সা.)-এর হাদীস, কুরআনের পরই যার অবস্থান, তাও একই বিপদের সম্মুখীন ছিল। কারণ, রাসূল (সা.)-এর হাদিসের ভাবার্থ মুলক বর্ণনা তার পরিবর্তন, পরিবর্ধন সংকোচন, বিস্মৃতি, বিকৃতি ও জালকৃত হওয়ার হাত থেকে আদৌ নিরাপদ ছিল না। কিন্ত রাসূল (সা.)-এর হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমন কি যেখানেই লিপিবদ্ধ কোন হাদীস পাওয়া যেত, সাথে সাথেই তা পুড়িয়ে ফেলা হত। পরিণতিতে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌছালো যে, খবু অল্প দিনের মধ্যেই নামায, রোযা.... ইত্যাদির মত ইসলামের অতীব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারেও পরস্পর বিরোধী মতামতের সৃষ্টি হল। একইভাবে এ যুগে ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোর উন্নয়নের ব্যাপারেও আদৌ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ, পবিত্র কুরআনে ও হযরত রাসূল (সা.)-এর হাদীসে, জ্ঞান অর্জন ও তার প্রসারের ব্যাপারে যে প্রশংসা, অনুপ্রেরণা ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, খেলাফতের যুগে এসে তা সম্পূর্ণ নিস্ক্রীয় ও স্থবির হয়ে পড়ে। অধিকাংশ মুসলমানই তখন একের পর এক রাজনৈতিক বিজয় নিয়ে মেতে ছিল। আর তখন তাদের যুদ্ধলদ্ধ গণিমতের সীমাহীন সম্পদের স্রোত সমগ্র আরব সাম্রাজ্যের দিকে ধাবিত হয়েছিল। যার ফলে নবীবংশের পবিত্র জ্ঞানের ঝর্ণাধারা থেকে উপ্রকৃত হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানরা আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়নি। ঐ পবিত্র জ্ঞানধারার উৎসমুখ ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.) তার ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন যে, হযরত আলী (আ.)-ই ইসলাম এবং পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি। এমন কি কুরআন সংগ্রহের সময়ও খেলাফত প্রশাসন হযরত আলী (আ.)-কে সে ব্যাপারে কোন পকার হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়নি। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে তার নামটাও তারা উচ্চারণ করেনি সেদিন। অথচ খেলাফত প্রশাসন এটা ভাল করেই জানতেন যে, রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (আ.) বহুদিন পর্যন্ত নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন। আর ঐ সময়ে তিনি কুরআনের সমগ্র লিপিসমূহকে একত্রিত ভাবে সংগ্রহ করে ছিলেন।৩৭ খেলাফত প্রশাসনের এমনই ধরণের আরও অনেক কর্মকান্ড হযরত আলী (আ.) এর ভক্ত ও অনুসারীদের বিশ্বাসকে অধিকতর সূদৃঢ় এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক হতে সাহায্য করেছিল। এর ফলে দিনের পর দিন তাদের কার্যক্রমের গতিও বহু গুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ওদিকে ব্যাপক ভাবে গণ-প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় হযরত আলী (আ.) ব্যক্তিগত পর্যায়ে লোক তৈরীর কাজ চালিয়ে যান। এই দীর্ঘ ২৫ বছরের মধ্যে হযরত আলী (আ.)-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারজন শিষ্য ও আপ্রাণ সহযোগীর তিনজনই পরলোক গমন করেন। যারা ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.), হযরত আবুযার গিফারী (রা.) এবং হযরত মিকদাদ কিন্ত ইতিমধ্যেই আরও বহু সংখ্যক সাহাবী এবং হেজাজ (বর্তমান সৌদি আরব), ইয়ামান, ইরাক সহ বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য তাবেয়ীন (যারা রাসূলের সাহাবীদের সাক্ষাত লাভ করেছেন) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারীতে পরিণত হন। যার ফলে তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর প্রশাসন রাজ্যের চতুর্দিক থেকে গণসমর্থনের জোয়ার হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দিকে ধাবিত হয়। সকলে গণভাবে হযরত আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তিনি খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন।

তথ্যসূত্র :

১। মহান আল্লাহ বলেছেন :  “স্মরণ রাখ! আল্লাহর অভিশাপ অত্যাচারীদের উপর নিপতিত, যারা আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তাতে বক্রতা সৃষ্টি করে। (-সুরা আল  আ’রাফ, ৪৪ ও ৪৫ নং আয়াত।)

২। মহান আল্লাহ বলেন : তার চেয়ে দ্বীনের ব্যাপারে কে উত্তম যে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করে এবং নিজেও সৎকর্ম পরায়ণ, আর একনিষ্ট ভাবে ইব্রাহীমের সরল ধর্মাদর্শ অনুসরণ করে? (-সূরা আন্ নিসা, ১২৫ নং আয়াত।)

মহান আল্লাহ আরো বলেছেনঃ  তুমি বল, হে ঐশী গ্রন্থের অধিকারীগণ! এসো, এমন এক কথায় (ঐক্য বদ্ধ হই) যা আমাদের ও তোমাদের মাঝেও একই (সমভাবে গ্রহণযোগ্য); যেন আমরা আল্লাহ ছাড়া আর অন্য কারো ইবাদত না করি এবং কোন কিছুকেই আল্লাহর সাথে শরীক  না করি। আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে যেন প্রতিপালক রূপে গ্রহণ না করে। যদি তারা এ প্রস্তাব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বল, ‘তোমরা সাক্ষী থেকো আমরা মুসলিম। (-সুরা আল্ ইমরান, ৬৪ নং আয়াত।)

মহান আল্লাহ বলেনঃ  হে মুমিনগণ   তোমরা সর্বাত্মকভাবে আত্মসমর্পণের স্তরে (ইসলামে) প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ককে অনুসরণ কর না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু ।(-সুরা আল্ বাকারা ২০৮ নম্বর আয়াত।)

৩। ‘যাইদিয়া’দের যে দলটি ইমাম আলী (আঃ)-এর পূর্ববতী  দু’জন খলিফাকে (১ম ও ২য় খলিফা) সঠিক বলে বিশ্বাস করে এবং ফেকাহগত দিক থেকে ইমাম আবু হানিফার অনুসারী,  তারাও শীয়া হিসেবে পরিচিত। তবে এরা বনি উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের মোকাবিলায় ইমাম আলী (আঃ) ও তার বংশধরদেরকেই (পবিত্র আহলে বাইত) খেলাফতের ন্যায্য অধিকারী বলে বিশ্বাস করে। এ কারণেই এদেরকেও শীয়া বলা হয়।

মহান আল্লাহ বলেনঃ (হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাইল বললেন) হে আমাদের প্রতিপালক ! আমাদের উভয়কে তোমার একান্ত অনুগত কর এবং আমাদের বংশধর হতে তোমার প্রতি অনুগত (মুসলিম) এক উম্মত (সৃষ্টি) কর”। (-সুরা আল বাকারা, ১২৮ নং আয়াত।)

মহান আল্লাহ বলেনঃ এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ । তিনিই পূর্বে তোমাদেরকে মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী) হিসেবে নাম করণ করেছেন। (-সুরা আল হাজ্জ, ৭৮ নং আয়াত।)

৪. রাসূল (সঃ)-এর জীবদ্দশায় সর্ব  প্রথম যে পরিভাষাটির উদ্ভব ঘটে, তা হল ‘শীয়া’। রাসুল (সঃ)-এর সাহাবী হযরত আবুযার (রাঃ), হযরত সালমান ফারসী (রাঃ), হযরত মিকদাদ (রাঃ), হযরত আম্মার ইয়াসিরও (রাঃ) রাসুল (সঃ)-এর জীবদ্দশাতেই এই খেতাবে ভূষিত ছিলেন। (হাদের আল   আলাম আল্  ইসলামী, ১ম খণ্ড, ১৮৮ নং পৃষ্ঠা)

৫. (হে রাসূল) আপনি নিকটতম আত্মীয়দেরকে সতর্ক  করে দিন। (সুরা ‘আশ শুয়ারা’ ২১৫ নং আয়াত)

৬. এ হাদীসে হযরত আলী (আঃ) বর্ণনা  করেনঃ আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ট।   আমি মহানবীকে (সঃ) বললামঃ ‘আমি আপনার প্রতিনিধি হব’। আল্লাহর রাসূল (সঃ) তার হাত আমার কাধে রেখে বললেন, ‘এ ব্যক্তি আমারই ভাই, আমার উত্তরাধিকারী এবং আমার স্থলাভিষিক্ত।  তোমরা অবশ্যই এর আনুগত্য  করবে’। উপস্থিত  লোকেরা হেসে আবু তালিবকে বলল, ‘তোমাকে এবার থেকে তোমার ছেলের আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছে।’ (‘তারিখে তাবারী, ২য় খণ্ড, ৩২১ পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড ১১৬ নম্বর পৃষ্ঠা। আল বিদায়াহ্  ওয়ান্  নিহায়াহ্  , ৩য় খণ্ড, ৩৯ নং পৃষ্ঠা। গায়াতুল মারাম, ৩২০ নং পৃষ্ঠা।)

৭. হযরত উম্মে সালমা হতে বর্ণিত; হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেনঃ  আলী (আঃ) সর্বদা সত্য ও কুরআনের সাথে রয়েছে। আর সত্য ও কুরআনও সর্বদা আলী (আঃ)-এর সাথে রয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না। এ হাদীসটি আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ১৫টি বর্ণনা সূত্র থেকে বর্ণিত হয়েছে। আর শীয়াদের ১১টি বর্ণনা সূত্র থেকে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। উম্মে সালমা, ইবনে আব্বাস, প্রথম খলিফা আবু বকর, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা, হযরত আলী (আঃ), আবু সাঈদ খুদরী, আবু লাইলা এবং আবু  আইয়ুব আনসারী প্রমুখ সাহাবীগণ হয়েছেন এ হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী, (-বাহরানী রচিত ‘গায়াতুল মারাম’ ৫৩৯ ও ৫৪০ নং পৃষ্ঠা)

হযরত মুহাম্মদ  (সঃ) বলেছেনঃ আলীর প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক, কেননা, সত্য সর্বদা তার সাথে রয়েছে। -আল বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ্  , ৭ম খণ্ড ৩৬ নং পৃষ্ঠা।

৮. হযরত রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ ‘হিকমাত (প্রজ্ঞা) দশ ভাগে বিভক্ত যার নয় ভাগই দেয়া হয়েছে আলী (আঃ)-কে এবং বাকী এক ভাগ সমগ্র মানব জাতির মাঝে বন্টন করা হয়েছে’। (-আল বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ্, ৭ম খণ্ড ৩৫৯ নং পৃষ্ঠা)

৯. যখন মক্কার কাফিররা আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর বাড়ী ঘেরাও করল, তখন মহা নবী (সঃ) মদীনায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং হযরত আলী (আঃ)-কে বললেন, তুমি কি আমার বিছানায় শুতে প্রস্তুত আছো, যাতে করে কাফেররা ভাববে আমিই বিছানায় ঘুমিয়ে আছি। আর এ ভাবে আমি তাদের পশ্চাদ্ববন বা তল্লাশী থেকে নিরাপদ থাকব। হযরত আলী (আঃ) ঐ বিপদজনক মূহুর্তে রাসূল (সঃ)-এর প্রস্তাবটি মনে প্রাণে মেনে নিলেন।

১০. ‘তাওয়ারীখ ও জাওয়ামিঈ হাদীস’।

১১. ‘গাদীরে খুমের’ হাদীসটি শীয়া ও সুন্নী উভয় সম্প্রদায়ের সর্বজন স্বীকৃত একটি হাদীস। শীয়া ও আহলে সুন্নাতের বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে শতাধিক সাহাবীর দ্বারা এ হাদীসটি বিভিন্ন ভাবে বর্ণিত হয়েছে যা উভয় সম্প্রদায়ের বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক পাঠকদের নিম্নলিখিত গ্রন্থ গুলো দেখার পরামর্শ দেওয়া হল। (‘গায়াতুল মারাম’ ৭৯ নং পৃষ্ঠা, ’আল গাদীর’ এবং ‘আবাকাতের’ ‘গাদীর খণ্ড দ্রষ্টব্য)

১২. ‘তারিখে ইয়াকবী’ -নাজাফীয় মুদ্রণ- ২য় খণ্ড, ১৩৭ ও ১৪০ নং পৃষ্ঠা। ‘তারিখে আবিল ফিদা’ ১ম খণ্ড ১৫৬ নং পৃষ্ঠা। ‘সহীহ্ বখারী’ ৪র্থ খণ্ড, ১০৭ নং পৃষ্ঠা। ‘মুরুযুয যাহাব’ ২য় খণ্ড, ৪৩৭ নং পৃষ্ঠা। ‘ইবনে আবিল হাদীদ’ ১ম খণ্ড, ১২৭- ১৬১ নং পৃষ্ঠা ১০- ‘সাহীহ মুসলিম’ ৫ম খণ্ড, ১৭৬ নং পৃষ্ঠা। ‘সহীহ বুখারী’ ৪র্থ খণ্ড, ২০৭ নং পৃষ্ঠা। ‘মুরুযুয যাহাব’, ২য় খণ্ড, ২৩ এবং ৪৩৭ নং পৃষ্ঠা। ‘তারীখু আবিল ফিদা’ প্রথম খণ্ড, ১২৭ ও ১৮৭ নং পৃষ্ঠা।

১৩. হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ আল্ আনসারী (রাঃ) বলেছেনঃ আমরা একবার মহানবী (সঃ)-এর সাথে ছিলাম। একটু দূরে হযরত আলী (আঃ)-কে দেখা গল। মহা নবী (সঃ) বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ এ ব্যক্তি (আলী) ও তার ‘শীয়ারাই’ (অনুসারী) কেয়ামতের দিন নাজাত (মুক্তি) পাবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, যখন এ আয়াতটি {যারা ঈমান আনে এবং সৎ কাজ করে, তারই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।-সূরা আল বাইয়িনাহ, ৭নং আয়াত} নাযিল হলো, রাসূল (সঃ) হযরত আলী (আঃ)-কে বললেন, তুমি এবং তোমার শীয়ারাই (অনুসারী) হচ্ছে এই আয়াতের বাস্তব উদাহরণ যারা কেয়ামতের দিন সন্তষ্ট থাকবে এবং আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তষ্ট থাকবেন। এ ছাড়াও এধরণের হাদীস নীচের গ্রন্থ গুলোতে উল্লেখিত হয়েছে : ‘দুররুল মানসুর’ ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩৭৯ নং পৃষ্ঠা। ‘গায়াতুল মারাম’ ৩২৬ নং পৃষ্ঠা।

১৪. মহানবী (সঃ) মৃত্যুর পূর্বে অসুস্থ অবস্থায় জনাব উসামা বিন যায়েদকে একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন। আর অন্য সবাইকে তিনি উসামার নেতৃত্বে ঐ বাহিনীতে যোগ দিয়ে মদীনার বাইরে যাওয়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্ত বেশকিছু সংখ্যক সাহাবী রাসূল (সঃ)-এর এই আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করেন। ঐসব বিরুদ্ধাচারীদের মধ্যে প্রথম খলিফা আবু বকর ও দ্বিতীয় খলিফা ওমরের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। এ বিষয়টি মহানবীকে (সঃ) ভীষণভাবে মর্মাহত করেছিল। [শারহু ইবনে আবিল হাদীদ, (মিশরীয় মুদ্রণ) ১ম খণ্ড ৫৩ নং পৃষ্ঠা]

মহানবী (সঃ) শেষনিশ্বাস ত্যাগের পূর্বে উপস্থিত সাহাবীদেরকে বললেনঃ কাগজ কলম নিয়ে এসো। আমি তোমাদের জন্যে এমন কিছু লিখে রেখে যেতে চাই, যা তোমাদের জন্যে হেদায়ত স্বরূপ হবে এবং যার ফলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। কিন্ত দ্বিতীয় খলিফা ওমর এ কাজের বিরোধীতা করলেন এবং বললেনঃ রাসূল (সঃ)-এর রোগ খুব চরম মাত্রায় পৌছে গেছে। তিনি প্রলাপ বকছেন।(তারিখে তাবারী, ২য় খণ্ড ৪৩৬ নং পৃষ্ঠা। সহীহ্ বুখারী ৩য় খণ্ড, সহীহ্ মুসলিম ৫ম খণ্ড, আল বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ্ , ৫ম খণ্ড ২২৭ নং পৃষ্ঠা। ইবনে আবিল হাদীদ, ১ম খণ্ড ১৩৩ নং পৃষ্ঠা।)

ঠিক একই ধরণের ঘটনা প্রথম খলিফা আবু বকরের মৃত্যুর সময় ঘটে ছিল। তখন প্রথম খলিফা দ্বিতীয় খলিফা ওমরকে তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনীত করে ওসিয়ত (উইল) লিখে যান। এমন কি ‘ওসিয়াত’ লিখার মাঝে তিনি সংজ্ঞাও হারিয়ে ফেলেন। কিন্ত তখন দ্বিতীয় খলিফা ওমর প্রতিবাদ করেননি। অথচ মহানবী (সঃ) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন এবং তার সাহাবীরাও সুস্থ ছিলেন। এ ছাড়া মহানবী (সঃ) ছিলেন সম্পূর্ণ মাসুম (নিস্পাপ)। (রওদাতুস্ সাফা’ ২য় খণ্ড, ২৫০ নং পৃষ্ঠা)

১৫. শারহু ইবনে আবিল হাদীদ’ ১ম খণ্ড, ৫৮ ও ১২৩ থেকে ১৩৫ নং পৃষ্ঠা। তারিখে ইয়াকুবী’ ২য় খণ্ড, ১০২ নং পৃষ্ঠা। তারিখে তাবারী’ ২য় খণ্ড, ৪৪৫ থেকে ৪৬০ নং পৃষ্ঠা।

১৬. তারিখে ইয়াকুবী’ ২য় খণ্ড ১০৩ থেকে ১০৬ নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা’ ১ম খণ্ড, ১৫৬ ও ১৬৬ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয যাহাব’ ২য় খণ্ড ৩০৭ নং ও ৩৫২ নং পৃষ্ঠা। শারহু ইবনি আবিল হাদীদ’ ১ম খণ্ড, ১৭ ও ১৩৪ নং পৃষ্ঠা।

১৭. জনাব ওমর বিন হুরাইস, সা’দ বিন যাইদকে, বলেছেনঃ প্রথম খলিফা আবু বকরের হাতে বাইয়াত গ্রহণের ব্যাপারে কেউ বিরোধীতা করেছিল কি?’ তিনি উত্তর দিলেনঃ শুধুমাত্র ‘মুরতাদ’ বা ‘মুরতাদ’সম লোক ছাড়া আর কেউই এর বিরোধীতা করেনি।(তারিখে তাবারী, ২য় খণ্ড, ৪৪৭ নং পৃষ্ঠা)

১৮. হাদীসে সাকালইনে বর্ণিত হয়েছে আমি আমানত স্বরূপ তোমাদের মাঝে দু‘টি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা ঐ দু‘টি বস্তু কে দৃঢ়ভাবে আকড়ে থাক তাহলে কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হচ্ছে : ‘কুরআন ও আমার পবিত্র আহলে বাইত (নবী বংশ), যা কেয়ামতের দিন পর্যন্ত কখনই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন হবে না। বিখ্যাত এ হাদীসটি যারা বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে রাসূল (সা.) এর সাহাবীই প্রায় ৩৫ জন এবং অন্য আরো শতাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। (গায়াতুল মারাম’ ২১১ নং পৃষ্ঠা, ও তাবাকাত গ্রন্থের সাকালাইন হাদীস দ্রষ্টব্য।) রাসূল (সা.) বলেছেনঃ আমি জ্ঞানের নগরী আর আলী (আ.) তার দরজা। যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী হবে, তাকে ঐ দরজা দিয়েই প্রবেশ করতে হবে। (আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ্ ’ ৭ম খণ্ড, ৩৫৯ নং পৃষ্ঠা)

১৯. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১০৫ থেকে ১৫০ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

২০. পবিত্র কুরআন, রাসুল (সা.) এবং পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) জ্ঞানার্জনের প্রতি অতিশয় গুরুত্ব আরোপ ও উৎসাহ প্রদান করতেন। জ্ঞানার্জনের প্রতি অনুপ্রেরণা প্রদান করতে গিয়ে এক পর্যায়ে মহা নবী (সা.) বলেনঃ জ্ঞান অর্জন প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই ফরজ। (বিহারুল আনোয়ার, ১ম খণ্ড, ১৭২ নং পৃষ্ঠা)

২১. আল বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্ , ৭ম খণ্ড, ৩৬০ নং পৃষ্ঠা।

২২. তারিখে ইয়াকুবী, ১১১, ১২৬, ও ১২৯ নং পৃষ্ঠা।

২৩. মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : পবিত্র কুরআন একটি সম্মানিত গ্রন্থ, যার সামনে ও পিছন থেকে কখনই মিথ্যা অনুপ্রবেশ করতে পারবে না।। -সূরা ফুসসিলাত, ৪১ও ৪২ নং আয়াত।

মহান আল্লাহ আরও বলেছেনঃ একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত নির্দেশ দেয়ার অধিকার আর কারও নেই । -সূরা আল ইউসুফ, ৬৭ নং আয়াত।

শরীয়ত বা ইসলামী বিধি বিধানের একমাত্র প্রতিভু আল্লাহই, যা নবীর মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌছানো হয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেনঃ বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্ব শেষ নবী। -সূরা আল আহযাব, ৪০ নং আয়াত।

এ আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ নবুয়্যত ও শরীয়তের (খোদায়ী বিধান) সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন ।

মহান আল্লাহ আরও বলেন : যারা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুসারে নির্দেশনা প্রদান করে না, তারাই কাফের - সরা আল মায়েদা, ৪৪ নং আয়াত।

২৪. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১১০ নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৫৮ নং পৃষ্ঠা।

২৫. দুররূল মানসুর, ৩য় খণ্ড, ১৮৬ নং পৃষ্ঠা। তারিখে ইয়াকুবী, ৩য় খণ্ড ৪৮ নং পৃষ্ঠা। এ ছাড়া পবিত্র কুরআনেও আবশ্যকীয় বিধান সুস্পষ্ট। যেমনঃ খুমস সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত : জেনে রাখ! যা কিছু তোমরা লাভ কর তা থেকে এক পঞ্চামাংশ আল্লাহর, রাসূল ও রাসূলের আত্মীয় স্বজনের প্রাপ্য। (-সূরা আল আনফাল, ৪১ নং আয়াত।)

২৬. প্রথম খলিফা আবু বকর তার খেলাফত কালে প্রায় পাঁচ শত হাদীস সংগ্রহ করেন। উম্মুল মুমিনীন আয়শা বর্ণনা করেনঃ এক দিন ভোর পর্যন্ত সারা রাত আমার পিতাকে মানসিক অস্তিরতায় ভুগতে দেখেছি। সকালে তিনি আমাকে বললেনঃ রাসূল (সঃ)-এর হাদীসগুলো নিয়ে এসো। অতঃপর তিনি আনীত ঐ হাদীসগুলো পুড়িয়ে ফেলেন। (কানযুল উম্মাল, ৫ম খণ্ড, ২৩৭ নং পৃষ্ঠা। )

দ্বিতীয় খলিফা ওমর প্রতিটি শহরে লিখিতভাবে এই মর্মে নির্দেশনামা পাঠান যে, যার কাছেই রাসূল (সঃ)-এর হাদীস রয়েছে সে যেন অতি সত্তর তা পুড়িয়ে ফেলে। (-কানযুল উম্মাল, ৫ম খণ্ড, ২৩৭ নং পৃষ্ঠা।) মুহাম্মদ বিন আবু বকর বলেনঃ দ্বিতীয় খলিফা ওমরের যুগে রাসূল (সঃ)-এর অসংখ্য হাদীস সংগৃহীত হয়েছিল। ঐগুলো যখন তার কাছে আনা হল তখন তিনি ওগুলো সব পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৫ম খণ্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা।)

২৭. তারিখে ইবনে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৫১ পৃষ্ঠা, ও অন্যান্য গ্রন্থ সমূহ।’

২৮. মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তার বিদায় হজ্জের সময় যেসব হাজীরা দূর-দূরান্ত থেকে মক্কায় প্রবেশ করত, তাদের জন্যে বিশেষ আইন প্রণয়ন করেন । যার উৎস ছিল পবিত্র কুরআনের এই আয়াত. ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা হজ্জ ও ওমরাহ একত্রে একইসাথে পালন করতে চাও .....’(-সূরা আল বাকারা -১৯৬ নং আয়াত।) কিন্তু দ্বিতীয় খলিফা তার খেলাফতের যুগে দূর থেকে আগত হাজীদের জন্যে হজ্জের ঐ আইনটি (হজ্জে তামাত্ত) বাতিল ও নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। ‘মোতাহ বা সাময়িক বিবাহ্’ যা আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর যুগে প্রচলিত ছিল, তাও দ্বিতীয় খলিফা ওমর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আর তিনি তার নির্দেশ অমান্যকারীদের পাথর মেরে হত্যার বিধান জারী করেন। একইভাবে হযরত রাসূল (সঃ)-এর যুগে, ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ অর্থাৎ উত্তম কাজের (নামাজের) দিকে ধাবিত হও ব্যাক্যটি আযানের মধ্যে উচ্চারিত হত । কিন্ত দ্বিতীয় খলিফা ওমর তার শাসন আমলে বলেন : এ ব্যাক্যটি জনগণকে জিহাদের অংশ গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে পারে! তাই তিনি তার খেলাফতের যুগে আযানে ঐ ব্যাক্যটির উচ্চারণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। হযরত রাসূলের (সা.) যুগে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী মাত্র এক বৈঠকে একটির বেশী ‘তালাক’ প্রদান বৈধ বলে গৃহীত হত না। কিন্ত দ্বিতীয় খলিফা ওমর তার শাসন আমলে একই বৈঠকে তিনটি ‘তালাক’ প্রদান জায়েয বলে ঘোষণা দেন!! একই বৈঠকে তিন তালাক গৃহীত হওয়ার বৈধতা তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন। উল্লেখিত বিষয়গুলো, হাদীস গ্রন্থ ও শীয়া এবং সুন্নী মাযহাবের ফেকহ ও ‘কালাম’ শাস্ত্রের গ্রন্থে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।

২৯. তারিখে ইয়াকুবী ২য় খণ্ড, ১৩১ নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠা।

৩০. আসাদুল গাবা, ৪র্থ খণ্ড, ৩৮৬ নং পৃষ্ঠা। আল-ইসাবাহ, ৩য় খণ্ড দ্রষ্টব্য।

৩১. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৫০ নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৬৮ নং পৃষ্ঠা। তারিখে তাবারী, ৩য় খণ্ড, ৩৭৭ নং পৃষ্ঠা।  

৩২. তারীখ ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৫০ নং পৃষ্ঠা। তারিখে তাবারী, ৩য় খণ্ড, ৩৯৮ নং পৃষ্ঠা।

৩৩. মিসরবাসীদের একটি দল তৃতীয় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। খলিফা এতে বিপদের আশংকা করলেন। তিনি এ ব্যাপারে হযরত আলী (আঃ)-এর সহযোগিতা প্রার্থনা করেন এবং কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচণা প্রকাশ করেন। তখন হযরত আলী (আঃ) মিসরবাসীদের উদ্দেশ্যেবলেনঃ তোমরাতো সত্যের বিজয়ের জন্যেই বিদ্রোহ করেছ। আর ওসমানও তার কুকর্মের জন্য অনুতপ্ত এবং তওবা করেছেন। তিনি বলেছেন : ‘আমি আমার অতীত কৃতকর্ম থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছি। আগামী তিন দিনের মধ্যেই তোমাদের দাবী-দাওয়া আমি বাস্তবায়ন করব এবং সকল অত্যাচারী প্রশাসকদের বরখাস্ত করব’। এর পর হযরত আলী (আঃ) তৃতীয় খলিফা ওসমানের পক্ষ হয়ে একটি সন্ধিপত্র প্রস্তুত করেন। অতঃপর বিদ্রোহীরা নিজ নিজ স্থানে ফিরে যায় । কিন্ত বিদ্রোহীরা বাড়ী ফেরার পথে তৃতীয় খলিফা ওসমানের জনৈক ক্রীতদাসকে তারই উটে চড়ে মিশরের দিকে যেতে দেখল। বিদ্রোহীরা সন্দিহান হয়ে ঐ ক্রীতদাসকে থামিয়ে তল্লাশী চালায়। ঘটনাক্রমে ঐ ক্রীতদাসের কাছে মিশরের প্রশাসককে লেখা তৃতীয় খলিফা ওসমানের একটি চিঠি তারা উাদ্ধার করে। ঐ চিঠিতে এ ভাবেই লখা ছিলঃ “আল্লাহর নামে শুরু করছি। যখন আব্দুর রহমান বিন উদাইস তোমার নিকট পৌছবে, তাকে ১০০টি চাবুক মারবে। তার চুল ও দাড়ি কামিয়ে ফেলবে এবং সুদীর্ঘ কারাবাসে নিবদ্ধ করবে। আর ওমর বিন আল- হামাক, সুদান বিন হামরান, এবং ‘উরওয়া বিন নাবা’র ব্যাপারেও একই নির্দেশ জারী করবে। বিদ্রোহীরা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত অবস্থায় ঐ চিঠি সহ ওসমানের কাছে ফিরে এসে বললঃ ‘আপনি আমাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছেন। কিন্ত ওসমান ঐ চিঠির বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। জবাবে বিদ্রোহীরা বললঃ আপনার ক্রীতদাসই এই চিঠিটার বাহক। ওসমান বললেনঃ সে আমার বিনা অনুমতিতে এ কাজ করেছে! তারা বললঃ সে আপনার উটেই চড়ে যাচ্ছিল। তিনি বললেনঃ ‘সে আমার উট চুরি করেছে’! তারা বললোঃ ‘চিঠিতো আপনার ব্যক্তিগত সেক্রেটারীর লেখা’। তিনি বললেনঃ ‘সে আমাকে অবহিত না করেই এ কাজ করেছে’! তারা বললো : ‘তাহলে তো খেলাফতের কাজ পরিচালনা করার মত যোগ্যতা আদৌ আপনার নেই। শিগগীর ইস্তফা দিন। কারণ যদি প্রকৃতপক্ষে এ কাজ আপনার দ্বারাই ঘটে থাকে, তাহলে অবশ্যই খিয়ানত করেছেন। আর যদি এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপনার বিনা অনুমতিতে হয়ে থাকে তবে খেলাফতের ব্যাপারে আপনার অযোগ্যতা ও ব্যর্থতাই প্রমাণিত হল। সুতরাং ইস্তফা দিন, তা’নাহলে অত্যাচারী প্রশাসকদের বরখাস্ত করুন। এর উত্তরর ওসমান বললেনঃ ‘আমাকে যদি তোমাদের কথা মেনে চলতে হয়, তাহলে তো তোমরাই আমার শাসনকর্তা। সেখানে আমি কোন জন? তৃতীয় খলিফার এধরণের উত্তরে বিদ্রোহীরা চরমভাবে রাগান্বিত হয়ে ওঠে এবং বৈঠক ত্যাগ করে। (তারিখে তাবারী, ৩য় খণ্ড ৪০২- ৪০৯ নং পৃষ্ঠা। তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড ১৫০- ১৫১ নং পৃষ্ঠা।)

৩৪. তারিখে তাবারী, ৩য় খণ্ড, ৩৭৭ নং পৃষ্ঠা।  

৩৫. সহীহ বুখারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৮৯ নং পৃষ্ঠা। তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১১৩ নং পৃষ্ঠা।

৩৬. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১১১ নং পৃষ্ঠা। তারিখে তাবারী, ৩য় খণ্ড, ১২৯-১৩২ নং পৃষ্ঠা।

৩৭. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড ১১৩ নং পৃষ্ঠা। শারহু ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খণ্ড, ৯ নং পৃষ্ঠা। ইতিহাসে পাওয়া যায় যে, প্রথম খলিফা আবুবকর খেলাফতের ‘বাইয়াত’ প্রাপ্তির পর পরই হযরত আলী (আঃ)-এর নিকট থেকে তাঁর ‘বাইয়াত’ প্রাপ্তির জন্য লোক পাঠান। কিন্ত হযরত আলী (আঃ) উত্তর দিলেন, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে, কেবল মাত্র নামায ছাড়া আর অন্য কোন কারণে বাড়ীর বাইরে যাব না, যাতে করে আমি কুরআন সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করতে পারি। ইতিহাসে আরও পাওয়া যায় যে, রাসূল (সঃ)-এর মৃত্যুর প্রায় ছয় মাস পর তিনি আবু বকরের ‘বাইয়াত’ গ্রহণ করেন।

এ ঘটনাটি কুরআন সংগ্রহের কাজ সমাপ্ত হওয়ার একটি প্রমাণ স্বরূপ। অতঃপর হযরত আলী (আঃ) নিজ সংগৃহীত কুরআনকে উটের পিঠে করে জনগণের নিকট নিয়ে তাদেরকে দেখান। অথচ ‘ইয়মামার’ যুদ্ধের পর যখন কুরআন সংগ্রহের কাজ শুরু করা হয় সেটা ছিল প্রথম খলিফা আবু বকরের খেলাফতের দ্বিতীয় বছর। এ সমস্ত ঘটনা ইসলামের ইতিহাসসহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে।

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কুরআন ও ইমামত সম্পর্কে ইমাম জাফর ...
ফাদাক সম্পর্কে “প্রথম খলিফার ...
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাতের আলোকে ...
কোমে হযরত ফাতেমা মাসুমার (আ.) জন্ম ...
শ্রেষ্ঠ নারী হযরত ফাতিমাতুয ...
ইমাম হাসান (আ.) এর শাহাদাত
নবী রাসূল প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা
Apabila ada sebagian hukum Islam yang nampaknya bertentangan serta kontradiktif dengan ...
আবতার কে বা কা’রা?
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কতিপয় খুতবা ও ...

 
user comment