ইসলামের প্রকৃত ইতিহাসের শুভ সূচনা ঐ দিন থেকে হয়েছিল যে দিন মহানবী (সা.) রিসালাত ও নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভ করেন। এর ফলে অনেক স্মরণীয় ঘটনার উদ্ভব হয়। যে দিন মহানবী মানব জাতির হেদায়েতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন এবং ওহীর ফেরেশতার মাধ্যমে
إنّك لرسول الله ‘নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল’-এ আহবানধ্বনি শুনতে পেলেন সে দিন তিনি এক গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলেন যা অন্যান্য নবী-রাসূলও গ্রহণ করেছিলেন। ঐ দিন কুরাইশদের কাছে ‘আল আমীন’ (বিশ্বস্ত) উপাধিতে ভূষিত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নীতি এবং তাঁর মিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অধিকতর স্পষ্ট হয়ে গেল।
হিরা পর্বতে মহানবী (সা.)
হিরা পর্বত পবিত্র মক্কা নগরীর উত্তরে অবস্থিত। আধা ঘন্টার ব্যবধানে এ পর্বতের শৃঙ্গে আরোহণ করা যায়। বাহ্যত এ পর্বত কৃষ্ণ প্রস্তর দ্বারা গঠিত এবং জীবনের সামান্যতম চিহ্নও এ পর্বতে দৃষ্টিগোচর হয় না। এ পর্বতের উত্তরাংশে একটি গুহা আছে। অনেক পাথর অতিক্রম করে অবশেষে সেখানে পৌঁছানো যায়। এ গুহার উচ্চতা একজন মানুষের উচ্চতার সমান। এ গুহার একটি অংশ সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় এবং অন্যান্য অংশ সব সময় অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে।
কিন্তু এ গুহাটিই এমন সব (ঐতিহাসিক) ঘটনার সাক্ষী যে, আজও ঐ গুহার অব্যক্ত ভাষা থেকে এ সব ঘটনা শোনার তীব্র আকর্ষণ মানুষকে এ গুহার কাছে টেনে নিয়ে যায় এবং প্রচুর কষ্ট ও পরিশ্রম করে আগ্রহী দর্শনার্থী এ গুহার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়। এ গুহায় পৌঁছেই মানুষ ওহী অবতীর্ণ হওয়ার মহাঘটনা এবং বিশ্ব মানবতার মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। ঐ গুহাটি যেন তার অব্যক্ত ভাষায় (দর্শনার্থীদের) বলতে থাকে : এ স্থানটি কুরাইশ বংশের সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তিটির ইবাদাতগাহ্। তিনি নবুওয়াতের সুমহান মর্যাদায় সমাসীন হবার আগে বেশ কিছু দিবারাত্রি এখানে অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি এ স্থানটি ইবাদাত-বন্দেগী করার জন্য পছন্দ ও মনোনীত করেছিলেন যা ছিল নগর জীবনের সকল কোলাহল থেকে মুক্ত। তিনি পুরো রামাযান মাস এখানেই কাটাতেন। অন্যান্য মাসেও তিনি কখনো কখনো এখানে অবস্থান করতেন।
নবুওয়াতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবার আগে মহানবী (সা.) দু’টি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবতেন। বিষয় দু’টি ছিল :
১. তিনি পৃথিবী ও আকাশে বিদ্যমান ঐশ্বরিক শক্তি ও মহিমা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন। তিনি প্রতিটি সৃষ্ট অস্তিত্ববান সত্তার মুখাবয়বে মহান আল্লাহর নূর (আলো) এবং তাঁর সীমাহীন ক্ষমতা ও জ্ঞান প্রত্যক্ষ করতেন। আর এ পথেই অবস্তুগত ঊর্ধ্বলোক ও আধ্যাত্মিক জগতের প্রবেশদ্বারসমূহ তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যেত।
২. যে গুরুদায়িত্ব তাঁর কাছে অর্পণ করা হবে সে ব্যাপারেও তিনি চিন্তা করতেন। এতসব নৈতিক অধঃপতন, বিশৃঙ্খলা ও ফিতনা-ফাসাদ থাকা সত্ত্বেও তাঁর দৃষ্টিতে তদানীন্তন সমাজের (কাঙ্ক্ষিত) সংস্কার ও সংশোধন কোন অসম্ভব কাজ বলে গণ্য হয় নি। তবে সঠিক সংস্কারমূলক কর্মসূচী ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাও ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও দুরূহ। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি মক্কাবাসীদের পাপাচার ও বিলাসবহুল জীবনকে দেখেছেন এবং তাদের সংশোধন প্রক্রিয়ার ব্যাপারেও তিনি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেছেন।
তিনি নিস্প্রাণ ইচ্ছাশক্তিহীন প্রতিমা ও বিগ্রহসমূহের সামনে মক্কাবাসীদের নতজানু হওয়া ও ইবাদাত-বন্দেগী করার দৃশ্য দেখে খুবই মর্মাহত হতেন এবং তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে এ ব্যাপারে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের চিহ্ন স্পষ্টরূপে ফুটে উঠত। কিন্তু যেহেতু তাঁকে জনসমক্ষে সত্য প্রকাশ করার অনুমতি তখনও দেয়া হয় নি সেজন্য তিনি তা প্রকাশ্যে বর্ণনা করা থেকে বিরত থেকেছেন।
ওহী অবতরণের শুভ সূচনা
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা সৌভাগ্য ও হেদায়েতের গ্রন্থের (আল কোরআন) প্রারম্ভক ও শুভ সূচনা হিসাবে কিছু আয়াত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে পাঠ করেন। আর এ কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াতের মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত হলেন অর্থাৎ এ ঘটনার মধ্য দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত আনুষ্ঠানিকভাবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হল। ঐ ফেরেশতা ছিলেন হযরত জিবরাইল (আ.)। আর ঐ দিনটি ছিল মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের অভিষেক (মাবআ’স) দিবস।
দীর্ঘদিন তাঁর জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট ও সবচেয়ে উপভোগ্য মুহূর্তগুলো ছিল তাঁর হিরা গুহায় একাকী নির্জনবাস ও ইবাদাত-বন্দেগীর মুহূর্ত। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে তাঁর সময় ও মুহূর্তগুলো অতিবাহিত হচ্ছিল। অবশেষে এক বিশেষ দিবসে এক ফেরেশতা একটি ফলকসহ অবতীর্ণ হয়ে ঐ ফলকটি তাঁর সামনে তুলে ধরে বলেছিলেন, “পড়ুন।”যেহেতু তিনি উম্মী (নিরক্ষর) ছিলেন এবং কখনই কোন বই পাঠ করেন নি সেহেতু তিনি বলেছিলেন, “আমি তো পড়তে পারি না।”ওহী বহনকারী ফেরেশতা তাঁকে জড়িয়ে ধরে খুব শক্তভাবে চাপ দিলেন। এরপর তাঁকে পুনরায় পড়তে বললে তিনি ঐ একই উত্তর দিয়েছিলেন। ঐ ফেরেশতা পুনরায় তাঁকে জড়িয়ে ধরে খুব শক্তভাবে চাপ দেন। এভাবে তিন বার চাপ দেয়ার পর মহানবী (সা.) নিজের মধ্যে অনুভব করলেন যে, ফেরেশতার হাতে যে ফলকটি আছে তা তিনি পড়তে পারছেন। এ সময় তিনি ঐ আয়াতসমূহ পাঠ করলেন যা ছিল বাস্তবে মানব জাতির সৌভাগ্যদানকারী গ্রন্থের অবতরণিকাস্বরূপ। নিচে ঐ আয়াতগুলো উল্লেখ করা হলো :
)إقرأ باسم ربّك الّذي خلق، خلق الإنسان من علق، إقرأ و ربّك الأكرم، الّذي علّم بالقلم، علّم الإنسان ما لم يعلم(
“পড়ুন আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে এক বিন্দু জমাট রক্ত থেকে। পড়ুন আর আপনার প্রভু মহান (অত্যন্ত সম্মানিত)। যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষ যা জানত না তা তিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছেন।”(সূরা আলাক : ১-৫)
জিবরাইল (আ.) স্বীয় দায়িত্ব পালন করলেন। আর মহানবীও ওহী অবতীর্ণ হবার পর হিরা পর্বত থেকে নিচে নেমে আসলেন এবং হযরত খাদীজার গৃহের দিকে গমন করলেন।1
উপরিউক্ত আয়াতসমূহ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সংক্ষিপ্ত কর্মসূচী ও পরিকল্পনা স্পষ্ট করে দেয় এবং প্রকাশ্যে প্রমাণ করে যে, তাঁর ধর্মের মূল ভিতই হচ্ছে অধ্যয়ন, জ্ঞান ও বিজ্ঞান এবং কলমের ব্যবহার।
মিথ্যা কল্প-কাহিনীসমূহ
যে সব ব্যক্তি ও মনীষীর ব্যক্তিত্ব বিশ্বজনীন, ঐতিহাসিক ও জীবনী রচয়িতাগণ যতদূর সম্ভব তাঁদের জীবনী গ্রন্থাকারে লিখে সংরক্ষণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। এমনকি তাঁদের রচনা পূর্ণাঙ্গ করার জন্য তাঁরা বিভিন্ন স্থান সফর করেছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো কোন ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যাবে না ইতিহাসে যার জীবনের যাবতীয় বিশেষত্ব ও খুঁটিনাটি দিক তাঁর মতো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে; উল্লেখ্য যে, তাঁর সাহাবিগণ তাঁর জীবনের সমুদয় খুঁটিনাটি দিক ও ঘটনা যত্নসহকারে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করেছেন।
এই অনুরাগ, আকর্ষণ ও ভালোবাসা যেমনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের যাবতীয় খুঁটিনাটি দিক ও ঘটনা লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে ঠিক তদ্রূপ তা কখনো কখনো মহানবীর জীবনী গ্রন্থে বাড়তি অলংকার ও সজ্জা (যা ভিত্তিহীন) সংযোজনের কারণও হয়েছে। অবশ্য এ সব কাজ (ভিত্তিহীন কাহিনী ও বানোয়াট ঘটনাসমূহ) যেখানে অজ্ঞ বন্ধুদের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া অসম্ভব নয় সেখানে জ্ঞানী শত্রুদের দ্বারা তা সম্পন্ন হওয়া মোটেও অসম্ভব নয়। এ কারণেই কোন মনীষী বা ব্যক্তিত্বের জীবনী রচয়িতার ওপর অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব হচ্ছে ঐ মনীষী বা ব্যক্তিত্বের জীবনের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত দৃঢ়তা ও সতর্কতা অবলম্বন এবং সূক্ষ্ম ঐতিহাসিক মানদণ্ডে তার জীবনের ঘটনাসমূহ যাচাই বাছাই ও বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা ও অমনোযোগিতা পরিহার। এখন আমরা ওহী নাযিল হবার পরবর্তী ঘটনাসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করছি।
মহানবী (সা.)-এর মহান আত্মা ওহীর আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। ওহীর ফেরেশতা যা কিছু তাঁকে শিখিয়েছিলেন তা তাঁর হৃদয়ে সুগ্রথিত হয়ে যায়। এ ঘটনার পর ঐ ফেরেশতাই তাঁকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “হে মুহাম্মদ! আপনি মহান আল্লাহর রাসূল (প্রেরিত দূত)। আর আমি জিবরাইল।” কখনো কখনো বলা হয় যে, তিনি এ আহবানটি ঐ সময় শুনতে পেয়েছিলেন যখন তিনি হিরা পর্বত থেকে নিচে নেমে এসেছিলেন।
যা হোক, তিনি যখন (হিরা পর্বত থেকে ফিরে) ঘরে প্রবেশ করলেন তখন তাঁর সহধর্মিনী অস্থিরতা ও গভীর চিন্তার ছাপ তাঁর পবিত্র বদনমণ্ডলে প্রত্যক্ষ করলেন। তাই তিনি মহানবীর কাছে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। হিরা পর্বতের গুহায় যা ঘটেছিল মহানবী তা হযরত খাদীজার কাছে বর্ণনা করলেন। হযরত খাদীজাহ্ও গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে তাঁর দিকে তাকালেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করে বললেন, “মহান আল্লাহ্ আপনাকে সাহায্য করুন।”
এরপর মহানবী (সা.) ক্লান্তি অনুভব করে খাদীজাহ্ (আ.)-এর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, دثّريني “আমাকে ঢেকে দাও।”হযরত খাদীজাহ্ তাঁকে ঢেকে দিলেন এবং তিনি কিছুক্ষণ ঘুমালেন।
হযরত খাদীজাহ্ ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। তিনি আরবের অন্যতম জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইঞ্জিল পড়ার পর বেশ দীর্ঘদিন ধরে তিনি খ্রিষ্টধর্ম পালন করছিলেন। তিনি হযরত খাদীজার চাচাতো ভাই ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর স্ত্রী হযরত খাদীজাহ্ মহানবীর কাছ থেকে যা শুনেছিলেন তা বলার জন্য ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন এবং মহানবী তাঁকে যা বলেছিলেন তিনি তা হুবহু বর্ণনা করলেন। ওয়ারাকাহ্ চাচাতো বোনের কথা শোনার পর বলেছিলেন,
إنّ ابن عمّك لصادق و إنّ هذا لبدء النّبوّة و إنّه ليأتيه النّاموس الأكبر
“তোমার চাচার ছেলে (মহানবী) সত্য বলেছেন। যা তাঁর ক্ষেত্রে ঘটেছে আসলে তা নবুওয়াতের শুভ সূচনা মাত্র।
যা কিছু এখন আপনাদের কাছে বর্ণনা করা হলো তা মুতাওয়াতির (অকাট্য সূত্রে বর্ণিত) ঐতিহাসিক বিবরণসমূহেরই সার সংক্ষেপ যা সকল গ্রন্থেই লিপিবদ্ধ হয়েছে। তবে এ বর্ণনাটির ফাঁকে ফাঁকে এমন সব বিষয় দৃষ্টিগোচর হয় যা মহান নবীদের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান ও পরিচিতির সাথে মোটেও খাপ খায় না। এছাড়াও এতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর জীবনী থেকে যা কিছু আমরা পাঠ করেছি তার সাথেও এ সব বিষয়ের ব্যাপক ব্যবধান ও অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। এখন আমরা আপনাদের সামনে যা বর্ণনা করব তা আসলে অলীক কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয় ।
আমরা প্রখ্যাত মিশরীয় সাহিত্যিক ও লেখক ড. হাইকালের লেখা থেকে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। কারণ তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় যে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছেন সেখানে বলেছেন যে, একদল লোক শত্রুতা বা বন্ধুত্ববশত মহানবীর জীবনচরিত রচনা ও বর্ণনা করার ক্ষেত্রে অনেক মিথ্যার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, কিন্তু তিনি নিজেই এ স্থলে এসে এমন সব বিষয় বর্ণনা করেছেন যা নিশ্চিতভাবে ভিত্তিহীন, অথচ মরহুম আল্লামা তাবারসীর মতো কতিপয় শিয়া আলেম এ ব্যাপারে বেশ কিছু উপকারী বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।2 এখন সেই সব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কল্প-কাহিনীর কিয়দংশ উল্লেখ করা হলো :
১. মহানবী (সা.) যখন হযরত খাদীজার ঘরে প্রবেশ করলেন তখন তিনি চিন্তা করছিলেন যে, তিনি যা দেখেছেন সে ব্যাপারে কি তিনি ভুল করেছেন অথবা তিনি কি যাদুগ্রস্ত হয়ে গিয়েছেন! ‘আপনি সব সময় অনাথদের আদর-যত্ন করতেন এবং নিজ আত্মীয়-স্বজন ও জ্ঞাতি-গোত্রের সাথে সদাচরণ করতেন’-এ কথা বলার মাধ্যমে হযরত খাদীজাহ্ তাঁর অন্তর থেকে সব ধরনের সন্দেহ ও সংশয় দূর করে দিলেন। তাই মহানবী তাঁর দিকে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির ন্যায় তাকিয়ে একটি কম্বল এনে তাঁকে ঢেকে দিতে বললেন।৩
২. তাবারী ও অন্যান্য ঐতিহাসিক লিখেছেন, “মহানবী (সা.) যখন إنّك لرسول الله ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান আল্লাহর রাসূল’-এ আহবান শুনতে পেলেন তখন তাঁর সমস্ত দেহ কাঁপতে লাগল। তিনি পাহাড় থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললেন। অতঃপর ফেরেশতা তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে এ কাজ করা থেকে বিরত রাখলেন।”৪
৩. ঐ দিবসের পরে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পবিত্র কাবা তাওয়াফ করতে গেলেন। ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলকে দেখে তাঁর কাছে তিনি নিজের এ ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। ওয়ারাকাহ্ তা শুনে বলেছিলেন, “মহান আল্লাহর শপথ, আপনি এ জাতির নবী। আর প্রধান ফেরেশতা যিনি হযরত মূসা (আ.)-এর কাছে আসতেন তিনিই আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছেন। কতিপয় লোক আপনাকে প্রত্যাখ্যান করবে, আপনাকে অনেক কষ্ট ও যাতনা দেবে, আপনাকে আপনার শহর (মক্কা) থেকে বহিষ্কার করবে এবং আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।”তখন হযরত মুহাম্মদ (সা.) অনুভব করলেন যে, ওয়ারাকাহ্ সত্য কথা বলছেন।৫
বর্ণনার অসারত্ব ও ভিত্তিহীনতা
আমরা বিশ্বাস করি যে, এ সব ঘটনা যা ইতিহাস ও তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে তার সবই ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও মিথ্যা ।
প্রথমত এ সব বক্তব্য মূল্যায়ন করার জন্য আমাদের উচিত অতীতের মহান নবী-রাসূলদের জীবনেতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেয়া। পবিত্র কোরআনে তাঁদের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এবং তাঁদের পবিত্র জীবনের বর্ণনাসমেত প্রচুর বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত ও হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আমরা তাঁদের মধ্য থেকে কোন একজনের জীবনেও এ ধরনের অমর্যাদাকর ঘটনা দেখতে পাই না। পবিত্র কোরআনে হযরত মূসা (আ.)-এর ওপর ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সূচনা সংক্রান্ত পূর্ণ বিবরণ এসেছে এবং তাঁর জীবনেতিহাসের সকল বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর কখনই ঐ ধরনের ভয়-ভীতি ও অস্থিরতার কথা উল্লেখ করা হয় নি যার ফলে ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় তিনি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেবেন। অথচ মূসা (আ.)-এর জন্য ভয় পাওয়ার প্রেক্ষাপট ঢের বেশি ছিল। কারণ আঁধার রাতে নির্জন মরু-প্রান্তরে তিনি একটি বৃক্ষ থেকে আহবান শুনতে পেয়েছিলেন এবং এভাবেই তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাতের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।
পবিত্র কোরআনের বক্তব্য অনুযায়ী হযরত মূসা (আ.) এ সময় তাঁর শান্তি ও স্বস্তি বজায় রেখেছিলেন। তাই মহান আল্লাহ্ যখন তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, “হে মূসা! তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর”, তিনি তৎক্ষণাৎ তা নিক্ষেপ করেছিলেন। মূসা (আ.)-এর ভয় ছিল লাঠিটির দিক থেকে যা একটি বিপজ্জনক প্রাণীতে পরিণত হয়েছিল। তাহলে কি বলা যায় যে, ওহী অবতরণের শুভ সূচনালগ্নে মূসা (আ.) শান্ত ও ধীরস্থির ছিলেন, অথচ যে ব্যক্তি সকল নবী ও রাসূলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ তিনি ওহীর ফেরেশতার বাণী শুনে এতটা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন যে, পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে লাফিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন? এ কথা কি যুক্তিসংগত?
নিঃসন্দেহে যতক্ষণ পর্যন্ত নবীর আত্মা যে কোন দিক থেকে মহান আল্লাহর ঐশী রহস্য গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রজ্ঞাময় আল্লাহ্ তাঁকে নবুওয়াতের মাকামে অধিষ্ঠিত করবেন না। কারণ মহান নবীদের প্রেরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে সুপথ প্রদর্শন। যে ব্যক্তির আত্মিক (আধ্যাত্মিক) শক্তি এতটুকু যে, ওহী শোনামাত্রই আত্মহত্যা করতে প্রস্তুত হয়ে যান তাহলে তিনি কিভাবে জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করবেন?
দ্বিতীয়ত এটি কিভাবে সম্ভব হলো যে, মূসা (আ.) মহান আল্লাহর ঐশী আহবান শুনে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তৎক্ষণাৎ তিনি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তিনি যেন তাঁর ভাই হারুনকে তাঁর সহকারী নিযুক্ত করেন? কারণ হারুন (আ.) তাঁর চেয়ে অধিকতর প্রাঞ্জলভাষী ও বাকপটু ;৬ অথচ নবীদের নেতা দীর্ঘক্ষণ সন্দেহ ও সংশয়ের মধ্যেই থেকে যান। যখন ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল তাঁর অন্তঃকরণ থেকে সন্দেহ-সংশয়ের ধুলো দূর করে দেন তখন তা দূরীভূত হয়ে যায়।
তৃতীয়ত নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ওয়ারাকাহ্ খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী ছিলেন। যখন তিনি মহানবীর অস্থিরতা ও সন্দেহ-সংশয় দূর করতে চাইলেন তখন তিনি কেবল মূসা (আ.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির ঘটনা উল্লেখ করে বলেছিলেন, “এটি এমনই এক পদ যা হযরত মূসাকে দেয়া হয়েছিল।”৭
তাহলে এ থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে, জালকারী ইয়াহুদী চক্র এ ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল এবং তারা গল্পের নায়ক ওয়ারাকার ধর্ম সম্পর্কে অমনোযোগী থেকে গিয়েছে এবং এমতাবস্থায় তারা এ ধরনের গল্প ও উপাখ্যান তৈরি (জাল) করেছে?
এ ছাড়াও মহানবীর যে মহত্ত্ব ও উচ্চ মর্যাদার কথা আমরা জানি এ ধরনের কার্যকলাপ তার সাথে মোটেও খাপ খায় না। ‘হায়াতু মুহাম্মদ’ গ্রন্থের রচয়িতা একটি পর্যায় পর্যন্ত এ সব গল্প ও উপাখ্যানের বানোয়াট ও মিথ্যা হবার ব্যাপারে অবগত ছিলেন। তাই তিনি কখনো কখনো পূর্বোক্ত বিষয়াদি ‘যেমন বলা হয়েছে ঠিক তেমনি’-এ বাক্যসহকারে উদ্ধৃত করেছেন।
এ সব গল্প ও উপাখ্যানের বিপক্ষে শিয়া ধর্মীয় নেতৃবর্গ সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রতিরোধ করেছেন এবং সব কিছু বাতিল প্রমাণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ যুরারাহ্ ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “যখন হযরত জিবরাইল (আ.) মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিলেন তখন তিনি কেন ভয় পান নি এবং ওহীকে শয়তানের ওয়াসওয়াসাহ্ (প্ররোচনা) বলে মনে করেন নি?” তখন ইমাম সাদিক (আ.) বলেছিলেন, “মহান আল্লাহ্ তাঁর নবীর ওপর প্রশান্তি ও স্বস্তি অবতীর্ণ করেছিলেন এবং যা কিছু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে পৌঁছত তা এমনই ছিল যেন তিনি তা প্রত্যক্ষ করছেন।”৮
প্রখ্যাত আলেম মরহুম আল্লামা তাবারসী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে৯ এ অংশে বলেছেন, “উজ্জ্বল দলিল-প্রমাণ প্রেরণ করা ব্যতীত মহান আল্লাহ্ তাঁর নবীর ওপর কোন ওহী অবতীর্ণ করতেন না। তিনি উজ্জ্বল দলিল-প্রমাণ এজন্য প্রেরণ করতেন যাতে করে মহানবী (সা.) নিশ্চিত হন যে, তাঁর কাছে যা কিছু ওহী হয় তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়।”
কোন্ দিন প্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল
মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত দিবস তাঁর জন্ম ও ওফাত দিবসের মতোই ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে নিশ্চিত ও চূড়ান্ত নয়। শিয়া আলেমগণ প্রায় ঐকমত্য পোষণ করেন যে, মহানবী (সা.) ২৭ রজব নবুওয়াতের পদ লাভ করেন। ঐ দিন থেকেই তাঁর নবুওয়াত শুরু হয়েছিল। কিন্তু সুন্নী আলেমদের প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, মহানবী (সা.) পবিত্র রামযান মাসে এ সুমহান মর্যাদা লাভ করেছিলেন এবং পবিত্র বরকতময় এ মাসেই তিনি নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে জনগণকে পথ প্রদর্শন করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং রিসালাত ও নবুওয়াতের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
যেহেতু শিয়ারা নিজেদেরকে মহানবীর ইতরাত ও আহলে বাইতের অনুসারী বলে বিবেচনা করে এবং হাদীসে সাকালাইন অনুসারে তাদের ইমামদের বক্তব্য ও বাণীকে সব দিক থেকে অকাট্য ও শুদ্ধ বলে বিশ্বাস করে এ কারণেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির দিবস নির্ধারণ করার ব্যাপারে ঐ অভিমতের অনুসারী-যা মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত থেকে নির্ভুলভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর সন্তানগণ (আহলে বাইত) বলেছেন, “আমাদের বংশের প্রধান ব্যক্তিটি (মহানবী) ২৭ রজব নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।” এ সব পূর্ব প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ ও ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে উপরিউক্ত বক্তব্য ও অভিমতের সত্যতা ও নির্ভুল হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ও সংশয় পোষণ করা অনুচিত।
যে বিষয়টি (মহানবীর নবুওয়াতপ্রাপ্তির দিবস নির্ধারণ করার ব্যাপারে প্রচলিত) অপর একটি অভিমতের দলিল হিসাবে বিবেচিত তা হচ্ছে পবিত্র কোরআনের ঐ সকল আয়াত যেগুলোতে উল্লিখিত হয়েছে যে, এ গ্রন্থ (পবিত্র কোরআন) পবিত্র রামযান মাসে অবতীর্ণ হয়েছিল। যেহেতু নবুওয়াত দিবস ওহীর সূচনা এবং পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার দিবস ছিল অতএব, অবশ্যই বলা উচিত যে, নবুওয়াত দিবস যে মাসে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল সে মাসেই হতে হবে। আর ঐ মাসটি হচ্ছে পবিত্র রামযান মাস। এখন যে সব আয়াতে পবিত্র রামযান মাসে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর অনুবাদসহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
)شهر رمضان الّذي أنزل فيه القرآن(
রামযান মাসেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। (সূরা বাকারাহ্ : ১৮৫)
)حم و الكتاب المبين إنّا أنزلناه في ليلة مباركة(
হা মীম স্পষ্ট বর্ণনাকারী গ্রন্থের (পবিত্র কোরআন) শপথ, নিশ্চয়ই আমরা এ গ্রন্থকে একটি বরকতময় রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা দুখান : ২ ও ৩)
)إنّا أنزلناه في ليلة القدر(
আর উক্ত বরকতময় রজনী হচ্ছে ঐ শবে কদর (মহিমাময় রাত্রি) যা সূরা কদরে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে : “আমরা পবিত্র কোরআনকে কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি।”(সূরা কদর : ১)
মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণ বিভিন্ন উপায়ে উপরিউক্ত যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ খণ্ডন করেছেন। আমরা তন্মধ্যে কেবল কয়েকটি এখানে উল্লেখ করব :
প্রথম উত্তর : উপরিউক্ত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পবিত্র কোরআন রমযান মাসের একটি বরকতময় রাতে অবতীর্ণ হয়েছিল। আর উক্ত রজনী পবিত্র কোরআনে ‘শবে কদর’ অর্থাৎ ভাগ্য রজনী নামে পরিচিত হয়েছে। আর এ সব আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় না যে, ঐ রাতেই পবিত্র কোরআন মহানবী (সা.)-এর পবিত্র হৃদয়ের ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল, বরং পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন ধরনের নুযূল থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এ সব নুযূলের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মহানবীর ওপর পবিত্র কোরআনের ধারাবাহিক ও পর্যায়ক্রমিক নুযূল। আরেক ধরনের নুযূল হচ্ছে একত্রে একবারে সম্পূর্ণ কোরআনের নুযূল। লওহে মাহফূয (সংরক্ষিত ফলক) থেকে বাইতুল মামূরে সম্পূর্ণ কোরআন একত্রে একবারে অবতীর্ণ (নাযিল) হয়েছিল।১০ সুতরাং ২৭ রজব যদি মহানবী (সা.)-এর ওপর সূরা আলাকের কয়েকটি আয়াত এবং পবিত্র রমযান মাসে যদি (পবিত্র কোরআনের ভাষায়) লওহে মাহফূয নামক একটি স্থান থেকে অন্য এক স্থান যা রেওয়ায়েতসমূহে বাইতুল মামূর নামে অভিহিত (হয়েছে) সেখানে সম্পূর্ণ কোরআন একত্রে একবারে অবতীর্ণ হয়, তাহলে কি এতে কোন অসুবিধা ও আপত্তি থাকতে পারে?
এ বক্তব্য ও অভিমতের পক্ষে প্রমাণ হচ্ছে সূরা দুখানের ৩ নং আয়াতটি যাতে এরশাদ হচ্ছে:
আমরা পবিত্র কিতাবটি (কোরআন) একটি বরকতময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। [যে সর্বনামটি ‘কিতাব’ (গ্রন্থ)-এর দিকে প্রত্যাগমন করে সেই সর্বনামটি প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করলে] এ আয়াতটির স্পষ্ট প্রকাশিত অর্থ হচ্ছে এই যে, সম্পূর্ণ কিতাবটি পবিত্র রমযানের একটি বরকতময় রজনীতে অবতীর্ণ হয়েছে। অবশ্যই এ নুযূলটি ঐ নুযূল থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র যা মহানবীর নবুওয়াতের মাকামে অভিষেকের দিবসে বাস্তবায়িত হয়েছিল। কারণ নবুওয়াতের মাকামে অভিষেক দিবসে গুটিকতক আয়াতই (সূরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত) অবতীর্ণ হয়েছিল।
সার সংক্ষেপ
যে সব আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পবিত্র কোরআন রামযান মাসের কদরের পুণ্যময় রাতে অবতীর্ণ হয়েছিল সেগুলো থেকে প্রমাণিত হয় না যে, যে দিবসে মহানবী (সা.) নবুওয়াতের পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন এবং সর্বপ্রথম কয়েকটি আয়াতও অবতীর্ণ হয়েছিল সে দিবসটি ছিল পবিত্র রামযান মাসে। কারণ উপরিউক্ত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সম্পূর্ণ ঐশী গ্রন্থটি ঐ মাসে (রামযান মাসে) অবতীর্ণ হয়েছিল, অথচ মহানবীর নবুওয়াতের অভিষেক দিবসে কেবল গুটিকতক আয়াতই অবতীর্ণ হয়েছিল। এমতাবস্থায় পবিত্র কোরআনের সম্পূর্ণ অবতীর্ণ হওয়াটাই ঐ মাসে (রামযান মাসে) লওহে মাহফূয থেকে বাইতুল মামূরে সমগ্র পবিত্র কোরআনের অবতীর্ণ হওয়াকেই সম্ভবত বুঝিয়ে থাকবে। শিয়া ও সুন্নী আলেমগণ এতদ্প্রসঙ্গে বেশ কিছু হাদীসও বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল আযীম আয-যারকানী ‘মানাহিলুল ইরফান ফী উলূমুল কোরআন’ নামক গ্রন্থে ঐ সব রেওয়ায়েত বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।১১
দ্বিতীয় উত্তর
সবচেয়ে শক্তিশালী ও দৃঢ় উত্তর যা এখন পর্যন্ত আলেমদের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে এই দ্বিতীয় উত্তর। আল্লামা তাবাতাবাঈ তাঁর মূল্যবান তাফসীর গ্রন্থ ‘আল মীযান’-এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন।১২ এ উত্তরটির সার সংক্ষেপ নিচে উল্লেখ করা হলো :
‘আমরা এ গ্রন্থকে রামযান মাসে অবতীর্ণ করেছিলাম’-পবিত্র কোরআনের এ আয়াতটির প্রকৃত অর্থ কি? এ আয়াতটির প্রকৃত ও যথার্থ অর্থ হচ্ছে সম্পূর্ণ কোরআনের প্রকৃত স্বরূপ ও হাকীকত রামযান মাসে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র অন্তঃকরণের ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল। কারণ পর্যায়ক্রমিক (ধারাবাহিক) অস্তিত্ব ছাড়াও পবিত্র কোরআনের এমন এক প্রকৃত বাস্তব স্বরূপ আছে যার সাথে মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় রাসূলকে রামযান মাসের কোন একটি নির্দিষ্ট রজনীতে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন।
যেহেতু মহানবী সম্পূর্ণ পবিত্র কোরআন সম্পর্কে অবগত ছিলেন তাই যতক্ষণ পর্যন্ত পবিত্র কোরআনের ধারাবাহিক নুযূলের বিধান বাস্তবে জারী করা না হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পবিত্র কোরআনের ব্যাপারে ত্বরা না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।১৩
এ উত্তরটির সার সংক্ষেপ
পবিত্র কোরাআনের যেমন একটি সার্বিক তাত্ত্বিক ও প্রকৃত বাস্তব অস্তিত্ব আছে যা একযোগে একত্রে (একবারেই) পবিত্র রামযান মাসে অবতীর্ণ হয়েছিল ঠিক তেমনি এ গ্রন্থের আরেকটি অস্তিত্ব আছে যা পর্যায়ক্রমিক (ধারাবাহিক)-যার সূচনা মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতে অভিষেক দিবসে কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়েছে এবং মহানবীর জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত বলবৎ ছিল (অর্থাৎ পবিত্র কোরআনের ধারাবাহিক অবতরণ মহানবীর নবুওয়াতে অভিষেক দিবসে শুরু হয়ে তাঁর ওফাত পর্যন্ত বলবৎ ছিল।)
তৃতীয় উত্তর
পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সাথে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হওয়ার বিষয়টি যুগপৎ ছিল না।
ওহীর শ্রেণীবিভাগ বর্ণনা করার সময় সার সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে যে, ওহীরও বেশ কিছু পর্যায় আছে। ওহীর প্রথম পর্যায় : সত্য স্বপ্নদর্শন (এ পর্যায়ে নবী কেবল সত্য স্বপ্ন দর্শন করেন।) ওহীর দ্বিতীয় পর্যায় : নবী কর্তৃক গায়েবী ও ঐশী আহবান শুনতে পাওয়া (অর্থাৎ এ পর্যায়ে নবী অদৃশ্য ঐশী আহবান শুনতে পান), তবে এ ক্ষেত্রে তিনি কোন ফেরেশতাকে প্রত্যক্ষ করেন না; ওহীর চূড়ান্ত ও সর্বশেষ পর্যায় হচ্ছে নবী ফেরেশতার কাছ থেকে মহান আল্লাহর বাণী শোনেন যাঁকে তিনি দেখেন এবং যাঁর মাধ্যমে তিনি অন্যান্য জগতের প্রকৃত অবস্থা ও বাস্তবতাসমূহের সাথেও পরিচিত হন।
যেহেতু মানবাত্মার একেবারে প্রাথমিক পর্যায় ওহীর বিভিন্ন পর্যায় ধারণ করতে অক্ষম সেহেতু অবশ্যই ওহী ধারণ করার বিষয়টি পর্যায়ক্রমিকভাবে বাস্তবায়িত হতে হবে। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা উচিত মহানবীর নবুওয়াতে অভিষেক দিবসে (২৭ রজব) এবং এর পরেও আরো বেশ কিছুদিন পর্যন্ত তিনি স্বর্গীয় ঐশী আহবানই শুনতে পেতেন। তিনি শুনতে পেতেন যে, তিনি মহান আল্লাহর রাসূল। নবুওয়াত দিবসে তাঁর ওপর কোন আয়াতই অবতীর্ণ হয় নি। অতঃপর বেশ কিছুদিন পর পবিত্র রামযান মাসে পবিত্র কোরআনের ধারাবাহিক নুযূল শুরু হয়।
সুতরাং সংক্ষেপে বলা যায় যে, রজব মাসে মহানবীর নবুওয়াতে অভিষিক্ত হওয়ার বিষয়টি ঐ মাসেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সাথে মোটেও সংশ্লিষ্ট নয়। এ বক্তব্যের ভিত্তিতে মহানবীর যদি রজব মাসে নবুওয়াতে অভিষিক্ত এবং পবিত্র কোরআন যদি একই বছরের রমযান মাসে অবতীর্ণ হয় তাহলে কি কোন অসুবিধা আছে?
উপরিউক্ত উত্তরটি যদিও অনেক ঐতিহাসিক বর্ণনা ও বিবরণের সাথে খাপ খায় না (কারণ ঐতিহাসিকগণ স্পষ্ট বলেছেন যে, সূরা আলাকের কতিপয় আয়াত নবুওয়াতে অভিষিক্ত হওয়ার দিবসেই অবতীর্ণ হয়েছিল।) কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও এমন কিছু রেওয়ায়েত আছে যেগুলোতে মহানবীর নবুওয়াতে অভিষিক্ত হওয়ার দিবসের ঘটনাটি বলতে কেবল গায়েবী অর্থাৎ অদৃশ্য (ঐশী) আহবানের কথাই উল্লিখিত হয়েছে এবং পবিত্র কোরআন অথবা কতিপয় আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়টি বর্ণিত হয় নি; বরং নবুওয়াত দিবসের ঘটনা ঠিক এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ঐ দিন মহানবী একজন ফেরেশতাকে দেখতে পেয়েছিলেন যিনি তাঁকে সম্বোধন করে বলেছিলেন,
يا محمّد أنّك لرسول الله “হে মুহাম্মদ! নিশ্চয়ই আপনি মহান আল্লাহর রাসূল।” আবার কিছু সংখ্যক বর্ণনায় কেবল গায়েবী আহবান ও সম্বোধনধ্বনি শোনার কথাই বর্ণিত হয়েছে এবং কোন ফেরেশতাকে দেখার বিষয় উল্লিখিত হয় নি।
ওহী অবতীর্ণ বন্ধ থাকা প্রসঙ্গ
ওহীর আলোয় মহানবী (সা.)-এর আত্মা ও মন আলোকিত হয়ে গিয়েছিল; তিনি অত্যন্ত ভারী ও গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতেন যা মহান আল্লাহ্ তাঁর ওপর অর্পণ করেছিলেন। বিশেষ করে ঐ সময় যখন মহান আল্লাহ্ তাঁকে সম্বোধন করে বলেছিলেন,
)يا أيّها المدَّثِّرُ قُمْ فأنذرْ وربَّك فكبِّرْ(
“হে চাদরাবৃত, উঠুন, সতর্ক করুন, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করুন” -এ স্থলে এসে ঐতিহাসিকগণ, বিশেষ করে ঐতিহাসিক তাবারী যাঁর ইতিহাসগ্রন্থ ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের কল্পকাহিনী ও উপাখ্যান দিয়ে সজ্জিত নয় তিনি انقطاع وحي অর্থাৎ ‘ওহী অবতীর্ণ বন্ধ থাকা’ শীর্ষক একটি বিষয়ের অবতারণা করে বলেছেন, “ওহীর ফেরেশতাকে দেখা এবং পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াত শ্রবণ করার পর মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আরো বাণী অবতীর্ণ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, কিন্তু না ঐ সুদর্শন ফেরেশতার কোন খবর ছিল, না আর কোন গায়েবী বার্তা তিনি শুনতে পেলেন।
রিসালাতের সূচনালগ্নে যদি প্রত্যাদেশ বন্ধ থাকার বিষয় সত্য হয়ে থাকে তাহলে তা পবিত্র কোরআনের ধারাবাহিক অবতরণ ব্যতীত অন্য কিছু ছিল না। নীতিগতভাবে মহান আল্লাহর ঐশী ইচ্ছা এটিই ছিল যে, বিশেষ কল্যাণের ভিত্তিতে তিনি তাঁর ওহী ধারাবাহিক ও পর্যায়ক্রমিকভাবে অবতীর্ণ করবেন। আর যেহেতু ওহীর সূচনালগ্নে মহান আল্লাহর ওহী পরপর অর্থাৎ অবিরামভাবে অবতীর্ণ হয় নি তাই এ বিষয়টি অর্থাৎ ওহী অবতরণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার অর্থে আলোচিত হয়েছে; আর কখনই প্রকৃত অর্থে ওহী অবতীর্ণ হওয়া বিচ্ছিন্ন ও বন্ধ থাকে নি।
যেহেতু এ বিষয়টি (ওহী অবতরণ বন্ধ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া) স্বার্থান্বেষী মতলববাজ লেখকদের (অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করার) দলিল-প্রমাণে পরিণত হয়েছে তাই আমরা এ ব্যাপারে এমনভাবে আলোচনা করতে চাই যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ওহী অবতরণ বন্ধ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার শিরোনামে যে বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে তা বাস্তবতাবর্জিত এবং এ ভ্রান্ত বিষয়ের সমর্থনে পবিত্র কোরআনের যে কয়টি আয়াত ব্যবহার করা হয়েছে আসলে এ সব আয়াতের এ ধরনের প্রয়োগ ও ব্যবহারেরও কোন বাস্তবতা নেই।
বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য যে ঘটনাটি তাবারী বর্ণনা করেছেন তা আমরা এখানে উল্লেখ করব এবং এরপর আমরা তা খণ্ডন করব। তিনি লিখেছেন : “যখন ওহীর পরম্পরা বিচ্ছিন্ন ও বন্ধ হয়ে গেল, নবুওয়াতের অভিষেকের সূচনালগ্নে মহানবী (সা.)-এর মধ্যে যে অস্থিরতা, সন্দেহ ও সংশয় দেখা দিয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি হলো। হযরত খাদীজা’ও তাঁর মতো অস্থির হয়ে তাঁকে বলেছিলেন : আমি অনুমান করছি, আল্লাহ্ আপনার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন।”তিনি এ কথা শোনার পর হিরা পর্বতের দিকে চলে গেলেন। ঠিক তখনই পুনরায় তাঁর কাছে ওহী অবতীর্ণ হলো এবং তাঁকে নিম্নোক্ত এ কয়টি আয়াতের মাধ্যমে সম্বোধন করে বলা হলো :
)والضّحى واللّيل إذا سجى ما وَدَّعكَ ربُّك وما قلى و للآخرةُ خيرٌ لك من الأولى ولسوف يعطيك ربُّك فترضى، ألم يجدك يتيماً فآوى ووجدك ضالّاً فهدى ووجدك عائلاً فأغنى فأمّ اليتيمَ فلا تقْهر وأمَّ السّائل فلا تنهر وأمّا بنعمة ربِّك فحدِّثْ(
“মধ্যাহ্নের শপথ, আর রাতের শপথ যার আঁধার (সব কিছুকে) ছেয়ে ফেলে; আপনার প্রভু আপনাকে ত্যাগ করেন নি এবং (আপনার প্রতি) শত্রুতায় লিপ্ত হন নি। নিশ্চয়ই দুনিয়া অর্থাৎ পার্থিবজগৎ থেকে আখেরাত আপনার জন্য উত্তম। অতি শীঘ্রই আপনার প্রভু আপনাকে এমন সব জিনিস দেবেন যে, এর ফলে আপনি সন্তুষ্ট ও খুশী হবেন। আপনি স্মরণ করুন, যখন আপনি অনাথ ছিলেন তখন তিনি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। যখন আপনি অস্থির ও দিশেহারা ছিলেন তখন আপনাকে তিনি পথ-প্রদর্শন করেছেন, যখন আপনি দরিদ্র ও রিক্তহস্ত ছিলেন তখন তিনি আপনাকে অভাবশূন্য, বিত্তশালী করেছেন। তাই কখনই কোন অনাথকে কষ্ট দিবেন না এবং ভিক্ষুকের প্রতি রাগ করবেন না। আর আপনার প্রভুর নেয়ামতের ব্যাপারে আলোচনা করুন।”(সূরা দুহা : ১-১১)
এ সব আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণে মহানবী (সা.)-এর অন্তরে অস্বাভাবিক ধরনের আনন্দ ও প্রশান্তির উদ্ভব হয় এবং তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, যা কিছু তাঁর ব্যাপারে বলা হয়েছে তা সবই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।
এটি ‘ইতিহাস’ হতে পারে না, বরং মিথ্যা কল্প-কাহিনী
হযরত খাদীজাহ্ (আ.)-এর জীবনেতিহাস ইতিহাসের পাতায় পাতায় সুগ্রথিত হয়ে আছে। খাদীজার দৃষ্টিপটে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী এবং সৎ কর্মসমূহ ছিল প্রাণবন্ত ও জীবন্ত। তিনি মহান আল্লাহ্কে ন্যায়পরায়ণ বলে বিশ্বাস করতেন। তাই তাঁর মধ্যে কিভাবে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে এ ধরনের অদ্ভুত ও ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে পারে?
এমন ব্যক্তিকেই নবুওয়াতে অভিষিক্ত করা হয় যিনি প্রশংসিত ও উচ্চাঙ্গের চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী। আর স্বয়ং মহানবী (সা.) যতক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনর উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী এবং বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী না হবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে এ পদও দেয়া হবে না। এ সব চারিত্রিক গুণের শীর্ষে রয়েছে ইসমাত (পবিত্রতা), আত্মিক প্রশান্তি ও স্থিরতা এবং মহান স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীলতা; আর এ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার কারণে তাঁর মনে এ ধরনের অলীক ধ্যান-ধারণার উদ্ভব হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব ও অবাস্তব। পণ্ডিতগণ বলেছেন, মহান নবীদের পূর্ণতাপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া তাঁদের শৈশব ও বাল্যকাল থেকেই শুরু হয় এবং তাঁদের দৃষ্টির সামনে থেকে পর্দা ও অন্তরায়সমূহ একের পর এক বিদূরিত হতে থাকে এবং তাঁদের জ্ঞানগত যোগ্যতা পূর্ণতার পর্যায়ে উপনীত হয়। এর ফলে তাঁরা যা শোনেন এবং দেখেন সে সম্পর্কে সামান্যতম সন্দেহ তাঁদের মধ্যে দেখা দেয় না। যে ব্যক্তি এ সব পর্যায় আয়ত্ত করতে সক্ষম হবেন, মানুষের বিভিন্ন কথাবার্তা ও মন্তব্য তাঁর অন্তরে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ও সংশয়ের সৃষ্টি করতে পারবে না।
সূরা আদ-দুহার আয়াতসমূহ, বিশেষ করে (ما ودّعك ربّك وما قلى) অর্থাৎ ‘আপনার প্রভু আপনাকে ত্যাগ করেন নি এবং (আপনার বিরুদ্ধে) শত্রুতায় লিপ্ত হন নি’-এ আয়াতটি থেকে এতটুকু প্রতীয়মান হয় যে, কোন এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে এ কথা বলেছিল। তবে কে বলেছিল এবং তার এ কথা কতখানি মহানবী (সা.)-এর মন-মানসিকতার ওপর (নেতিবাচক) প্রভাব বিস্তার করেছিল এ ব্যাপারে কোন কিছুই উক্ত আয়াতে বর্ণিত হয় নি।
কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, “কয়েকজন মুশরিক মহানবীকে এ কথা বলেছিল। আর এ সম্ভাবনার ভিত্তিতেই সূরা আদ-দুহার সকল আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সূচনালগ্নের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে পারে না। কারণ নবুওয়াতের অভিষেকের সূচনালগ্নে একমাত্র খাদীজাহ্ ও আলী ব্যতীত আর কোন ব্যক্তিই ওহী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না-যার ফলে তার পক্ষে এ ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য ও কটুক্তি করা সম্ভব হবে। এমনকি পুরো তিন বছর মহানবী (সা.)-এর রিসালাত ও নবুওয়াত অধিকাংশ মুশরিক থেকে গোপন রাখা হয়েছিল। আমরা এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত আলোচনা রাখব। এ সময় তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ইসলাম ধর্ম প্রচারের আদেশ পান নি। অতঃপর (فاصدع بما تؤمر)‘আপনি যে ব্যাপারে আদিষ্ট হচ্ছেন তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন’-এ আয়াত অবতীর্ণ হলে তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য জনগণকে আহবান জানিয়েছিলেন অর্থাৎ প্রকাশ্যে মহানবীর দাওয়াতী কর্মকাণ্ড শুরু হয় উপরিউক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পরপরই।
ওহী অবতরণ বন্ধ ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যাপারে সীরাত রচয়িতাদের মধ্যে মতপার্থক্য
পবিত্র কোরআনে কোথাও ওহী অবতরণ বন্ধ ও বিচ্ছিন্ন থাকার কথা বর্ণিত হয় নি। এমনকি এতৎসংক্রান্ত সামান্যতম ঈঙ্গিতও দেয়া হয় নি। এ বিষয়টি কেবল সীরাত ও তাফসীরের গ্রন্থসমূহেই দেখা যায়। আর ওহী অবতরণ বন্ধ ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ ও সময়কালের ব্যাপারে সীরাত রচয়িতা ও মুফাসসিরদের এতটা মতপার্থক্য রয়েছে যে, এর ফলে তাঁদের কারো বক্তব্য ও অভিমতের ওপর মোটেও নির্ভর করা যায় না। আমরা নিচে তাঁদের অভিমত ও বক্তব্যসমূহ উত্থাপন করছি :
১. ইয়াহুদীরা মহানবী (সা.)-কে আত্মা, গুহাবাসীদের অর্থাৎ আসহাবে কাহাফের কাহিনী এবং যুলকারনাইন-এ তিনটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। মহানবী (সা.) ‘ইনশাআল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহ্পাক যদি চান’ না বলে বলেছিলেন, ‘আগামীকাল আমি তোমাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেব।’ এ কারণে মহান আল্লাহর ওহী অবতীর্ণ হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মুশরিকরা ওহী অবতীর্ণ হতে বিলম্ব হওয়ায় খুব আনন্দিত হয়ে বলতে লাগল, “মহান আল্লাহ্ মুহাম্মদকে ত্যাগ করেছেন।”মুশরিকদের এ অমূলক চিন্তা খণ্ডন করার জন্যই সূরা দুহা অবতীর্ণ হয়।”১৪
সুতরাং উপরিউক্ত বর্ণনার ভিত্তিতে সূরা আদ-দুহা মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতে অভিষেকের সূচনালগ্নের সাথে সংশ্লিষ্ট তা বলা যায় না। কারণ ইয়াহুদী আলেমগণ মহানবী (সা.)-এর কাছে উপরিউক্ত বিষয় তিনটি সম্পর্কে নবুওয়াতে অভিষেকের আনুমানিক ৭ম বর্ষে প্রশ্ন করেছিল যখন মহানবী (সা.)-এর রিসালাতের বাস্তবতা ইয়াহুদী আলেমদের কাছে উত্থাপন করে তা আসলে সত্য কিনা তা জানার জন্য কুরাইশদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল মদীনা সফরে গিয়েছিল। ঐ সময় ইয়াহুদী পণ্ডিতগণ উক্ত প্রতিনিধি দলটিকে উপরিউক্ত তিনটি বিষয়ে মহানবী (সা.)-কে প্রশ্ন করার পরামর্শ দিয়েছিল।১৫
২. মহানবী (সা.)-এর খাটের নিচে একটি কুকুরের বাচ্চা মারা গেলে কেউ তা প্রত্যক্ষ করে নি। মহানবী (সা.) ঘর থেকে বাইরে গেলে খাওলা ঘর ঝাড়ু দেয়ার সময় তা বাইরে ফেলে দেয়। ঐ সময় ওহীর ফেরেশতা সূরা আদ দুহাসহ আগমন করেন। মহানবী (সা.)-কে ফেরেশতা বলেছিলেন, إنّا لا ندخل بيتاً فيه كلبٌ “যে গৃহে কুকুর আছে সেই গৃহে আমরা (ফেরেশতাগণ) প্রবেশ করি না।”১৬
৩. মুসলমানগণ ওহী অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মহানবী (সা.) বলেছিলেন, “যখন তোমরা তোমাদের নখ ও গোঁফ ছোট করো না তখন কিভাবে ওহী অবতীর্ণ হবে?”১৭
৪. হযরত উসমান একবার কিছু আঙ্গুর অথবা রসালো খেজুর হাদিয়াস্বরূপ মহানবী (সা.)-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। ভিক্ষুক এলে মহানবী তা তাকে দিয়ে দেন। হযরত উসমান ঐ আঙ্গুর বা খেজুর ঐ ভিক্ষুকের কাছ থেকে কিনে তা পুনরায় মহানবীর কাছে প্রেরণ করেন। আবারও ঐ ভিক্ষুক মহানবী (সা.)-এর কাছে যায় এবং এ কাজ তিনবার সংঘটিত হয়। অবশেষে মহানবী (সা.) দয়ার্দ্র কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি ভিক্ষুক না ব্যবসায়ী।”ঐ ভিক্ষুকটি মহানবী (সা.)-এর কথায় খুব মর্মাহত হয় এবং এ কারণেই মহানবীর ওপর ওহী অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব ঘটে।১৮
৫. মহানবী (সা.)-এর কোন এক স্ত্রীর অথবা আত্মীয়ের কুকুরশাবক মহানবী (সা.)-এর কাছে জিবরাইল (আ.)-এর অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।১৯
৬. মহানবী (সা.) ওহী অবতরণে বিলম্ব হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে জিবরাইল (আ.) বলেছিলেন, “এ ব্যাপারে আমার কোন ইখতিয়ার নেই।”
এরপরও এ ক্ষেত্রে আরো কিছু অভিমত ও বক্তব্য আছে। আগ্রহী পাঠকবর্গ বিভিন্ন তাফসীর অধ্যয়ন করে দেখতে পারেন।২০
কিন্তু ইত্যবসরে তাবারী এমন একটি দিক ও কারণ উদ্ধৃত করেছেন এতৎসংক্রান্ত বিভিন্ন কারণ ও দিকের মধ্যে কেবল এ দিকটির প্রতিই অর্বাচীন লেখকগণ যাঁরা কোন বিবেচনা ও যাচাই না করে অভিমত ব্যক্ত করেন তাঁরা আকৃষ্ট হয়েছেন; আর তাঁরা একে মহানবী (সা.)-এর অন্তরে সন্দেহ ও সংশয়ের উদ্রেক হওয়ার নিদর্শন বলে গণ্য করেছেন। সেই দিক বা কারণ হচ্ছে, হিরা পর্বতের গুহায় ওহী অবতরণ ও নবুওয়াতে অভিষেকের ঘটনার পর মহানবী (সা.)-এর ওপর ওহী অবতরণ হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। হযরত খাদীজাহ্ (আ.) তখন মহানবীকে বলেছিলেন, “আমি ধারণা করছি, মহান আল্লাহ্ আপনার ওপর অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং আপনার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়েছেন।”আর ঠিক তখনই ওহী অবতীর্ণ হলো :
)ما ودّعك ربُّك وما قلى(
“আপনার প্রভু আপনাকে ত্যাগ করেন নি এবং আপনার প্রতি শত্রুভাবাপন্নও হন নি।”২১
এ সব অর্বাচীন লেখকের দুরভিসন্ধি পোষণ অথবা যাচাই বাছাই ও গবেষণা না করার প্রমাণ হচ্ছে এই যে, এ ব্যাপারে এত সব বর্ণনা, বক্তব্য ও অভিমত থাকতে তাঁরা কেবল এ বর্ণনাটি গ্রহণ করে তা এমন এক ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে তাঁদের ফায়সালা ও মতামতের ভিত্তি হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন যাঁর সমগ্র জীবনে সন্দেহ ও সংশয়ের কোন নিদর্শনই খুঁজে পাওয়া যাবে না। নিম্নোক্ত দিকগুলো বিবেচনা করলে উপরিউক্ত বর্ণনার ভিত্তিহীনতা ও মিথ্যা হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। দিকগুলো হলো :
১. হযরত খাদীজাহ্ (আ.) এমন এক মহীয়সী নারী ছিলেন যিনি সর্বদা মহানবীকে ভালোবাসতেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি স্বামীর পথে আত্মত্যাগ করে গেছেন। তিনি তাঁর সমুদয় ধন-সম্পদ মহানবী (সা.)-এর সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য ওয়াক্ফ্ করে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতে অভিষেকের বর্ষে তাঁদের বৈবাহিক জীবনের ১৫টি বছর অতিবাহিত হয়েছিল। এ দীর্ঘ সময় হযরত খাদীজাহ্ (আ.) মহানবী (সা.) থেকে কেবল পবিত্রতা ব্যতীত আর কিছুই প্রত্যক্ষ করেন নি। তাই মহানবী (সা.)-এর প্রতি অনুরক্ত ও নিবেদিতা এমন নারীর পক্ষে এ ধরনের কর্কশ ও নিষ্ঠুর কথা বলা কখনই সম্ভব নয়।
২. (ما ودَّعك ربُّك وما قلى) (আপনার প্রভু আপনাকে ত্যাগ করেন নি এবং আপনার বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হন নি)-এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় না যে, হযরত খাদীজাহ্ এ ধরনের (জঘন্য) উক্তি করে থাকতে পারেন, বরং এ আয়াতটি থেকে এতটুকু প্রমাণিত হয় যে, মহানবী (সা.)-এর ব্যাপারে কোন ব্যক্তি এ ধরনের কথা বা মন্তব্য করেছিল। তবে এ উক্তি কে করেছিল এবং কেনই বা সে এ ধরনের উক্তি করেছিল তা স্পষ্ট নয়।
৩. এ ঘটনা বা কাহিনীর বর্ণনাকারী যিনি একদিন খাদীজাহ্ (আ.)-কে মহানবী (সা.)-এর ভরসা ও সান্ত্বনা দানকারী হিসাবে এভাবে পরিচিত করিয়ে দেন যে, তিনি এমনকি মহানবী (সা.)-কে আত্মহত্যা করা থেকে বিরত রেখেছিলেন, অথচ আরেকদিন সে একই ব্যক্তি আবার হযরত খাদীজার চেহারা এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে, তিনি (নাউযুবিল্লাহ্) নাকি মহানবীকে বলেছিলেন, “মহান আল্লাহ্ আপনার শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছেন।” তাহলে আমরা কি এ কথা বলতে পারি না যে, মিথ্যাবাদীর স্মৃতিশক্তি নেই? (যে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী সে আগে কি কথা বলেছে পরে তা স্মরণ রাখতে পারে না। তাই তার পূর্বের বক্তব্যের সাথে পরবর্তী উক্তি ও বক্তব্যের পার্থক্য স্পষ্ট হয়।)
৪. হিরা পর্বতের গুহার ঘটনা অর্থাৎ নবুওয়াতের অভিষেক এবং সূরা আলাকের কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর সূরা দুহা অবতীর্ণ হওয়া পর্যন্ত যদি ওহী অবতরণ বন্ধ থাকে এমতাবস্থায় সূরা দুহাকেই কোরআন অবতরণের ধারাবাহিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে পবিত্র কোরআনের ২য় সূরা বলে গণ্য করতে হবে, অথচ পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার ধারাবাহিকতা অনুসারে এ সূরাটি পবিত্র কোরআনের দশম সূরা।২২
সূরা দুহা অবতীর্ণ হওয়া পর্যন্ত যে সব সূরা অবতীর্ণ হয়েছিল সেগুলো নিচে বর্ণিত হলো :
১. সূরা আল আলাক, ২. সূরা আল কলম, ৩. সূরা আল মুয্যাম্মিল, ৪. সূরা আল মুদ্দাসসির, ৫. সূরা লাহাব, ৬. সূরা আত তাকভীর, ৭. সূরা আল ইনশিরাহ্, ৮. সূরা আল আসর, ৯. সূরা আল ফাজর এবং ১০. সূরা আদ দুহা।
ইতোমধ্যে ইয়াকূবী তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে সূরা দুহা অবতীর্ণ হওয়ার তারিখের দৃষ্টিতে পবিত্র কোরআনের ৩য় সূরা হিসাবে গণ্য করেছেন। আর এ অভিমতটিও উপরিউক্ত বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়।
ওহী অবতরণ কতদিন বন্ধ ছিল এতৎসংক্রান্ত মতপার্থক্য
ওহী অবতরণ বন্ধ থাকার সময়কাল অত্যন্ত অস্পষ্ট এবং বিভিন্নভাবে তা বর্ণিত হয়েছে। আর তাফসীরের গ্রন্থসমূহে ওহী অবতরণ কতদিন বন্ধ ছিল সে ব্যাপারে নিম্নোক্ত বক্তব্যসমূহ পরিলক্ষিত হয়। যেমন ৪ দিন, ১২ দিন, ১৫ দিন, ১৯ দিন, ২৫ দিন ও ৪০ দিন।
তবে পবিত্র কোরআনের ধারাবাহিক অবতরণের অন্তর্নিহিত দর্শন নিয়ে যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব যে, ওহী অবতরণ বন্ধ থাকার বিষয়টি কোন বিচ্ছিন্ন ও ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ছিল না। কারণ পবিত্র কোরআন প্রথম দিন থেকেই ঘোষণা করেছে যে, মহান আল্লাহ্ এ গ্রন্থটি (কোরআন) ধীরে ধীরে (পর্যায়ক্রমে) নাযিল করার ইচ্ছা করেছেন। পবিত্র কোরআনে এতদপ্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে :
)وقرآناً فرقْناه لتقرأه على النّاسِ على مكْثٍ(
“আর এ কোরআনকে ধাপে ধাপে নাযিল করেছি যাতে করে আপনি তা ধীরে ধীরে বিরতিসহকারে জনগণের কাছে পাঠ করেন।”(সূরা আল ইসরা : ১০৬)
পবিত্র কোরআনের অন্যত্র এ গ্রন্থের পর্যায়ক্রমিক অবতরণের মূল রহস্য উন্মোচন করে বলা হয়েছে :
)وقال الذين كفروا لولا نزّل عليه القرآن جملةً واحدةً كذالك لنثبّت به فؤادك ورتّلناه ترتيلاً(
“আর কাফিররা বলেছে : কেন কোরআনকে একবারে অবতীর্ণ করা হয় নি; আর আমরা তা এভাবেই অবতীর্ণ করেছি যাতে করে আমরা আপনার অন্তঃকরণকে দৃঢ় ও স্থির রাখতে পারি এবং আমরা এ গ্রন্থকে এক ধরনের বিশেষ শৃঙ্খলা দান করেছি।”(সূরা ফুরকান :৩২)
আমরা যদি পবিত্র কোরআনের অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে একটু গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে কখনই এটি আশা করা উচিত নয় যে, প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্তে হযরত জিবরাইল (আ.) মহানবী (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ রাখবেন এবং আয়াত অবতীর্ণ হবে; বরং পবিত্র কোরআনের পর্যায়ক্রমিক অবতরণের যে সব অন্তর্নিহিত রহস্য ও কারণ বিদ্যমান আছে এবং মুসলিম গবেষক আলেমগণ যেগুলো বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন২৩ সেগুলোর জন্যই পবিত্র কোরআন চাহিদা ও প্রয়োজন মাফিক বিভিন্ন সময়গত ব্যবধানে প্রশ্নকারীদের প্রশ্নসমূহের ভিত্তিতে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রকৃত
প্রস্তাবে কখনই ওহী অবতরণ বন্ধ থাকে নি, বরং ওহী তাৎক্ষণিক অবতরণের কোন কারণই আসলে তখন বিদ্যমান ছিল না।
তথ্যসূত্র ও টিকা:
১. সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৬; সহীহ আল বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩; হাদীসের এ অংশটি যা আমরা এখানে বর্ণনা করেছি তা সহীহ (সত্য) ও নির্ভুল। তবে এ হাদীসের নিচে পাদটীকায় কোন শোভাবর্ধক বাড়তি বর্ণনা নেই; আর যদি থেকে থাকে তাহলে তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যাত বলে গণ্য হবে। আমরা মাফাহীমুল কোরআন গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে সনদ ও মতনের (মূল পাঠ) দিক থেকে এ হাদীস প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি।
২. মাজমাউল বায়ান, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৩৮৪।
৩. তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৯; হায়াতু মুহাম্মদ (সা.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯৫।
৪. তারিখে তাবারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৫।
৫. তাফসীরে তাবারী, ৩০তম খণ্ড, পৃ. ১৬১, সূরা আলাকের ব্যাখ্যা এবং সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৮।
৬. সূরা ত্বাহা : ২৯।
৭. هذا النّاموس الّذي أنزل على موسى بن عمران- সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৮; মরহুম আল্লামা মাজলিসী বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থের ১৮তম খণ্ডের ২২৮ পৃষ্ঠায় আল মুনতাকা গ্রন্থ থেকে এবং و عيسى ‘এবং ঈসা’ শব্দও বর্ণনা করেছেন; তবে এ কাহিনীর উৎস সহীহ বুখারী ও সীরাতে ইবনে হিশামে و عيسى শব্দটির উল্লেখ নেই।
৮. إنّ الله اتّخذ عبدا رسولا أنزل عليه السّكينة و الوقار فكان الّذي يأتيه من قبل الله مثل الّذي يراه بعينه- বিহারুল আনওয়ার, ১১তম খণ্ড, পৃ. ৫৬।
৯. মাজমাউল বায়ান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৮৪।
১০. লওহে মাহফূয ও বাইতুল মামূর সংক্রান্ত ব্যাখ্যা জানার জন্য আগ্রহী পাঠকবর্গকে তাফসীরের গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
১১. মানাহিলুল ইরফান ফী উলূমুল কোরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭।
১২. আল মীযান, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪-১৬।
১৩. لا تعجل بالقرآن من قبل أن يُقضى إليك وحيه “আপনার প্রতি ওহী (অবতীর্ণ) করার আগেই পবিত্র কোরআনের ব্যাপারে ত্বরা করবেন না”Ñ সূরা ত্বাহা : ১১৪।
১৪. তাফসীর-ই রুহুল মাআনী, ৩০তম খণ্ড, পৃ. ১৫৭; সীরাতে হালাবী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৯-৩৫০।
১৫. সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০০-৩০১।
পৃ. ৩৪৯-৩৫০।
১৬. তাফসীরে কুরতুবী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৭১-৮৩; সীরাতে হালাবী, ১ম খণ্ড, পৃ.৩৪৯।
১৭. প্রাগুক্ত।
১৮. তাফসীরে রূহুল মাআনী, ৩০তম খণ্ড, পৃ. ১৫৭।
১৯. তাফসীরে তাবারীর টীকা সম্বলিত ‘গোরায়েবুল কোরআন’ (পবিত্র কোরআন সংক্রান্ত আশ্চর্যজনক বিষয়াদি) নামক গ্রন্থ; তাফসীরে আবুল ফাতূহ, ১২শ খণ্ড, পৃ. ১০৮।
২০. মাজমাউল বায়ান, ১০ম খণ্ড, সূরা আদ দুহার তাফসীর।
২১. তাফসীরে তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৫২।
২২. যানজানী প্রণীত তারীখুল কোরআন, পৃ. ৫৮।
২৩. পবিত্র কোরআনের পর্যায়ক্রমিক অবতরণের রহস্যসমূহ সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হওয়ার জন্য ‘খিমা-ই ইনসানে কামেল দার কোরআন’ (পবিত্র কোরআনে ইনসানে কামিলের স্বরূপ) নামক গ্রন্থের ১৪০-১৫০ পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করুন।
মোহাম্মদ মুনীর হোসাইন খান কর্তৃক অনূদিত চিরভাস্কর মহানবী (সা.) গ্রন্থ থেকে সংকলিত#আল-হাসানাইন