নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,
'আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া!'
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে!
.. ...
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্-
'আরশের' পায়া ধরে, কাঁদে মাতা ফাতেমা,
"এয়্ খোদা বদ্ লাতে বেটাদের রক্তের
মার্জ্জনা কর গোনা পাপী কম্ বখতের |"
ইসলাম নারী ও পুরুষের সম্মিলিত ইতিহাস। ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন একজন নারী তথা উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সালামুল্লাহি আলাইহা) এবং প্রায় একই সময়ে পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন হযরত আলী (আ.) মাত্র দশ বছর বয়সে। হযরত খাদিজা (সা.) ছিলেন আরবের শীর্ষস্থানীয় ধনী ও সম্পদশালী। কিন্তু রাসূল (সা.)'র স্ত্রী হওয়ার পর তিনি তাঁর প্রায় সব সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাসূল (সা.) যখনই হযরত খাদিজা (সা.)'র নাম নিতেন তাঁর পবিত্র চোখ দুটি অশ্রুতে ভরে যেত। ইসলামের প্রথম শহীদও ছিলেন একজন নারী, হযরত সুমাইয়া (রা.)। কারবালার বীর শহীদানদের মধ্যে নারীও ছিলেন। হযরত খাদিজার কন্যা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমাকে (সালামুল্লাহি আলাইহা) বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা। পিতা বিশ্বনবী (সা.)' জন্য অশেষ স্নেহ-ভালবাসা ও সেবার কারণেই এই উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়াও মুসলমানদের সচেতন করার জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ও হাদীস প্রচার করে গেছেন এই মহীয়সী নারী। তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় কবি বলেছেন:
বিশ্ব দুলালী নবী-নন্দিনী/ খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী ।
হাসান হোসাইন তব উম্মত তরে মাগো,/ কারবালা প্রান্তরে দিলে বলিদান।
বদলাতে তার রোজ হাশরে,/ চাহিবে মা মোর মত পাপীদের ত্রাণ।
তাই এটা স্পষ্ট ইসলামের সেবায় সেই প্রাথমিক যুগেও নারী রেখেছিল এমন এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা যা গুরুত্বের দিক থেকে পুরুষের চেয়ে কম তো নয়ই বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যুগান্তকারী, অনন্য ও ঐতিহাসিক। কারবালার মহাবিপ্লবও এর ব্যতিক্রম নয়। কারবালার অসম যুদ্ধে যারা ইমাম হুসাইনের পক্ষে তথা খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামকে রক্ষার লড়াইয়ে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন তাদের অনেকেই এই মহান সংগ্রামে যোগ দেয়ার ও অবিচল থাকার প্রেরণা পেয়েছিলেন পুণ্যবতী জননী বা স্ত্রীর কাছ থেকে। নারীদের ওপর জিহাদ ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও দুজন মুমিন নারী শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের জন্য লড়াইয়ের ময়দানে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরিয়ে আনেন।
কারবালার বীরত্ব-গাঁথার অপরিহার্য অংশ হলেন হযরত যেইনাব (সা.)। তাঁকে ছাড়া কারবালার বিপ্লব হয়ে পড়ত অসম্পূর্ণ। তিনি ছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)'র বোন ও নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা (সা.)'র কন্যা। হযরত যেইনাব (সা.) যদি কারবালার ঘটনাগুলো তুলে না ধরতেন এবং কুফায় ও ইয়াজিদের দরবারে ভাষণ না দিতেন তাহলে হয়তো কারবালার প্রকৃত ঘটনা মানুষ কখনও জানতেই পারত না। আসলে তিনি ছিলেন এ বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের অন্যতম প্রধান পরিচালক।
হযরত যেইনুল আবেদীন (আ.) অসুস্থ ছিলেন বলে কারবালার জিহাদে অংশ নিতে পারেননি। আর অসুস্থ বলেই ইয়াজিদ সেনাদের কেউ কেউ ভেবেছিল, এ তো এমনিতে মরবে, ওকে আর মারার দরকার নেই। আশুরার দিন বিকেলে হযরত যেইনাব (সা.) বিশেষভাবে সমহিমায় সমুদ্ভাসিত হয়েছিলেন। ইমাম হুসাইনের শাহাদতের পর শিমার হযরত যেইনুল আবেদীন (আ.)-কে হত্যা করতে উদ্যত হলে যেইনাব (সা.) এসে তাঁর ওপর হাত বাড়িয়ে ধরায় ও ইবনে সাদ শিমারকে নিরস্ত করায় নবী বংশের শেষ চেরাগটি রক্ষা পান। কারবালার ঘটনার আগে ও পরে এই মহান ইমামের সেবা-শুশ্রূষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ফুফু হযরত যেইনাব (সা.)।
কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
খাঁ-খাঁ করে কারবালা, নাই পানি খর্জ্জুর,
মা'র স্তনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়্ পায় !
জিভ চুষে' কচি জান থাকে কিরে ধড়্ টায় ?
দাউ দাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
কাঁদে বানু----"পানি দাও, মরে যাদু আস্ গর !"
পেলো না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন্ !
পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে
ছিঁড়ে আনে মর্ম্মের বত্রিশ বাঁধনে !
তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল,
"দাদা ! তেরি ঘর্ কিয়া বরবাদ্ পয়মাল !"
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ইসলামকে রক্ষার জন্য নিজেকে কুরবানি করতে রাজি হয়েছিলেন মহান আল্লাহর নির্দেশে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য। কিন্তু তিনি কেন এই মহাবিপজ্জনক সফরে নারীসহ পরিবার-পরিজনকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন? এর উত্তরেও তিনি বলেছিলেন যে, নিশ্চয় আল্লাহ চান যে নবী পরিবারের নারীরাও বন্দিনী হবে। আসলে এরই মধ্যে ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি। মহান আল্লাহ ঈমানের পরীক্ষায় নারীদেরও উত্তীর্ণ হতে দেখতে চেয়েছেন।
হযরত যেইনাব (সা.) নিজের জীবনের চেয়েও ভালবাসতেন ভাই ইমাম হুসাইন (আ.) ও ভাতিজাদেরকে। ইমামের জন্য যেইনাব (সা.)'র দুই তরুণ বা শিশুপুত্র শহীদ হলেও তিনি মোটেও ব্যথিত হননি। কিন্তু যখন ভাইপো আলী আকবর (রা.) শহীদ হন তখন তিনি তাঁর লাশ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ও বিলাপ করেন। (এই আলী আকবর ছিলেন দেখতে অবিকল বিশ্বনবী-সা.'র মত, তাঁর আচরণও ছিল মহানবী (সা.)'র অনুরূপ এবং এমনকি তাঁর কণ্ঠস্বরও ছিল হুবহু রাসূল-সা.'র কণ্ঠের মত। এ কারণে সাহাবী ও নবী পরিবারের অনেকেরই প্রাণ যখন রাসূলেরসা. জন্য কাঁদত, তখন তারা এই তরুণকে দেখতে আসতেন!)
ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর প্রায় সব পুরুষ সঙ্গী এবং আপনজনদের নির্মমভাবে শহীদ করার পর হুসাইন-শিবিরে ইয়াজিদ সেনারা অগ্নিসংযোগ করেছিল ও লুণ্ঠন করেছিল মালপত্র। এ ছাড়াও নরপশু ইয়াজিদ সেনারা মস্তকবিহীন পবিত্র লাশগুলোর ওপর ঘোড়া ছুটিয়ে ছিন্ন-ভিন্ন করেছিল পবিত্র লাশগুলো। এরপর ১২ ই মহররম নবী পরিবারের নারী ও শিশুদের বন্দী অবস্থায় উটে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দামেস্কের দিকে। ৭২ জন ইয়াজিদ সেনার বর্শার চূড়ায় বিদ্ধ ছিল নবী-দুলালদের কর্তিত মস্তক। আপনজনদের দলিত ও বিকৃত লাশগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হযরত যেইনাব যে ভাষায় বিলাপ করেছিলেন তা শত্রুদেরও অশ্রু-সজল করে। একজন ইয়াজিদি সেনা বলেছিল: আমি কখনও সে মর্মাহত বেদনা ভুলতে পারব না যখন হুসাইন (আ.)'র বোন যেইনাব (সা.) তাঁর ভাইয়ের ছিন্ন-ভিন্ন দেহ অতিক্রম করেছিলেন তখন তিনি কেঁদে কেঁদে বলছিলেন: "হে মুহাম্মাদ (সা.)! হে মুহাম্মাদ(সা.)! আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা তোমার ওপর দরুদ ও সালাম পাঠায়। আর এই তোমার আদরের হুসাইন, কী ভীষণভাবে লাঞ্ছিত, অবহেলিত, রক্তাপ্লুত খণ্ডিত লাশ হয়ে আছে!
হে মুহাম্মাদ (সা.)! তোমার কন্যারা আজ বন্দিনী, তোমার জবাই করা পরিবার আজ অপেক্ষা করছে পূবের হাওয়ার জন্য, কখন ধুলো এসে তাঁদের ঢেকে দেবে!"
উল্লেখ্য নবী-পরিবারের বন্দী নারীদের অনুরোধেই তাঁদেরকে ইমাম হুসাইন (আ.)'র শাহাদত-স্থলের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে দামেস্কের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় যেইনাব (সা.) ইমামের মস্তকবিহীন লাশের পাশে যেসব বিলাপ করেন তাতে শত্রু-বন্ধু নির্বিশেষে সবাই কাঁদতে বাধ্য হয়। কিন্তু এ সময়ও তিনি ইমাম যেইনুল আবেদীন (আ.)'র অসুস্থতার কথা ভুলেননি। পিতার ও প্রিয়জনদের লাশ দেখে তরুণ ও অসুস্থ ইমামের প্রাণ যেন দেহের খাঁচা ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
এ সময় যেইনাব (সা.) রাসূল (সা.) একটি হাদিস শুনিয়ে ভাতিজাকে সান্ত্বনা দেন এবং ওই হাদিসের বক্তব্য অনুযায়ী বলেন: 'এখন যেখানে হুসাইনের লাশ দেখতে পাচ্ছ, সেখানে কাফন ছাড়াই তাঁর লাশ দাফন করা হবে। এখানে হুসাইনের কবর যিয়ারতগাহে পরিণত হবে।'
অর্থাত এর পর থেকে ইসলাম হবে আরও প্রাণবন্ত, প্রোজ্জ্বল, আহলে বাইত হবে অমর।
রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া-দামেশ্ কে-
"জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে ?"
' হায় হায় হোসেনা', ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তল্ ওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায় !
উন্ মাদ 'দুল্ দুল্' ছুটে ফেরে মদিনায়,
আদি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায় !
মা ফতেমা আস্ মানে কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস !
রণে যায় কাসিম ঐ দু'ঘড়ির নওশা,
মেহেদীর রঙটুকু মুছে গেল সহসা !
'হায় হায়' কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা----
'কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেল সকীনা !'
কাঁদে কে রে কোলে ক'রে কাসিমের কাটা-শির ?
খান্ খান্ হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর !
কেঁদে গেছে থামি' হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র !
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
"আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা !"
নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার !
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস,
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্ মনও 'সাব্বাস্' !
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর "শির দেগা, নেহি দেগা আমামা !"
source : http://bangla.irib.ir