মুফতী মো. মাহবুবুর রহমান বিন্নুরী
হজ কি?
ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি হলো হজ। আল্লাহর সাথে বান্দার সুনিবিড় সেতু-বন্ধন তৈরি করে দেয় এ হজ। দেখলে মনে হয় যেন নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহসহ সুনির্দিষ্ট কিছু স্থানে গমন করা, বিশেষ ভঙ্গিতে সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মসম্পাদন করার নামই হজ। আসলে কিন্তু তা নয়, কারণ অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় হজের বাহ্যিক রূপটা কিছুটা ভিন্ন। পাথরের গায়ে চুমু, এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে দৌড়া-দৌড়ি, নিসক পাথরের তৈরি একটি ঘরের প্রদক্ষিণ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। কেমন মনে হলেও প্রতিটি বিষয়ের সাথেই জড়িয়ে আছে হৃদয়ের আকর্ষণ ও অন্তরের গহীনে লুকিয়ে থাকা বিধাতার সাথে বান্দার সুনিবিড় সম্পর্ক। তাই তো মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ফারুকে আযম উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) হাজরে আসওয়াদের বুকে চুমুখেতে গিয়ে বলেছিলেন ওহে! আমি খুবভালো করেই জানি তুমি নিছক একটি পাথর- ভালো মন্দের কোনই ক্ষমতা তোমার নেই। আমি যদি নবীজীকে (স.) তোমার গায়ে চুমু খেতে না দেখতাম, তাহলে কখনোই তোমাকে আমি চুমু দিতাম না। (বোখারী শরীফ-১/২১৭ পৃ.)। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়ে উঠে যে, ইসলাম কেবল বাহ্যিক আচার সর্বস্ব নয় বরং বাহ্যিকতার চেয়ে আন্তরিকতার স্থানই এতে বেশি। তাই সূচনাকাল থেকেই কাবা ঘর ও তার আশপাশ এলাকার সাথে মিশে আছে সকল মুমিন মুমিনাতের হৃদয়ের সুগভির ভালোবাসা।
হযরত ইব্রাহিম ও হযরত ইসমাইল (আ.) উভয় পিতা-পুত্র কাবা ঘরটি পুনর্নির্মাণ করার পর আল্লাহকে বলেছিলেন : প্রভু হে! নির্জন-নিরালা মরুভূমিতে তোমার নির্দেশে আমরা ঘর বানিয়েছি এবার হুকুম তোমার! আল্লাহ বললেন, ইব্রাহিম এবার মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে। যেন তারা নিজেদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাজির হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিজক দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম যাতে স্মরণ করতে পারে। (সুরা : হাজ্জ ২৭-২৮ নং আয়াত)।
উক্ত আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যায় সাহাবী ও তাবেয়ীনদের থেকে বিশুদ্ধভাবে একটি বর্ণনা রয়েছে যে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) এ নির্দেশ পাওয়ার পর বলেছিলেন, ‘হে আমার আল্লাহ! আমার এ ঘোষণা তাদের পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিবে কে? এখানে তো জনমানবহীন বন্য প্রান্তর। ঘোষণা শুনার মতো কেউ নেই। যেখানে জনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌঁছবে?'
ইরশাদ হলো : ‘হে ইব্রাহিম, তোমার দায়িত্ব হলো ঘোষণা দেয়া, আর পৌঁছানোর দায়িত্ব তো আমার। হযরত ইব্রাহিম (আ.) মাকামে ইব্রাহিমে দাঁড়ালেন, অন্য বর্ণনায় রয়েছে তিনি আবু কুবাইছ পর্বতের উপর দাঁড়িয়ে দুই কানে আঙ্গুল রেখে ডানে-বামে, পূর্বে ও পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে আওয়াজ দিলেন- ওহে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের উপর এর তাওয়াফ ফরজ করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন কর।'
আল্লাহ তায়ালা তার কুদরতী ক্ষমতাবলে হযরত ইব্রাহিম নবীর এ আহ্বানকে বিশ্বের কোণে কোণে পৌঁছে দেন। তদানীন্তন বিশ্বের সকল জীবিত মানবম-লী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং কিয়ামত পর্যন্ত সমাগত সকল মানুষের কানেই এ আওয়াজ পৌঁছে দেয়া হয়। যাদের নসীবে আল্লাহপাক হজ লিখে দিয়েছেন তারা সকলেই ইব্রাহিম নবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলেছিল, ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক' হে আল্লাহ! আমি তো তোমার ঘরে উপস্থিত হতে প্রস্তুত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ইব্রাহিম নবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘লাব্বায়ক' বলাই হচ্ছে হজের মূলভিত্তি। (মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৪২১ ইবনে আব্বাস থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত)।
হজের ফজিলত
হজ-ওমরা এক ফজিলত ও সওয়াব সম্পর্কে নবীজী (সা.) সাহাবায়ে কিরামগণকে অনেক আলোচনা শুনিয়েছেন এর থেকে কয়েকটি বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
রাসূলে আকরাম (স.) ইরশাদ করেন, এক উমরা হতে অপর উমরা মধ্যবর্তী সময়ের সুন্নাহের কাফফারা হয়ে থাকে। আর হজে মাবরুরের প্রতিদান একমাত্র জান্নাত। (বুখারী ১৭৭৩ নং হাদীস পৃ: ১/২৩৮, মুসলিম ৩২৭৬ নং হাদীস, পৃ. ১/৪৩৬ পৃ.)।
হজে মাবরুর ঐ হজকে বলা হয় যা সর্বপ্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সবধরনের পাপাচার মুক্ত হয় এবং আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার মানদ-েও উত্তীর্ণ হয়।
একবার সরওয়ারে কায়েনাত (স.) কে জিজ্ঞাসা করা হল, কোন আমল সবচেয়ে উত্তম? তিনি বললেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ইমান আনা। জিজ্ঞাস করা হল এরপর কোনটি? ইরশাদ করলেন আল্লাহর পথে জিহাদ করা। জিজ্ঞাসা করা হল এরপর কোনটি? তিনি বললেন, এরপর মাবরুর হজ।
(বোখারী শরীফ-হাদীস নং-১৫১৯, পৃ:-১:২০৬/মুসলিম ১:৪৩৬ পৃ.)।
রাসূলে করীম (সা.) আরো বলেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করল এবং যৌনসম্ভোগ ও শরীয়ত বিরোধী কর্মকা- হতে বিরত রইল সে তার মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ট হওয়ার দিনের মতো নিষ্পাপ অবস্থায় ঘরে ফিরে এলো। (বুখারী-১৫২১ নং হাদীস ১: ২০৬ পৃ: মুসলিম- ৩২৭৮ নং হাদীস ১:৪৩৬ পৃ.)।
ছোট বাচ্চা যখন মায়ের পেট থেকে দুনিয়াতে আগমন করে তখন সে থাকে একেবারেই পূত-পবিত্র, নিষ্ফলক বেগুনাহ মাসুম, ঠিক তদরূপ পূর্ণ ইয়াকিনের সাথে যে ব্যক্তি হজ-ওমরা করল এবং সব ধরনের অশ্লীল কর্মকা- থেকে বিরত থাকলো সেও সদ্য প্রসূত বাচ্চার মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরে আসে। (মুসলিম শরীফ-১/৪৩৬-ফতহুল বারী-৫/১৫৬ পৃ.)।
এ ফযীলত নারী-পুরুষ উভয়ে সমানভাবেই পাবে। নারীর জন্য হজ জিহাদতূল্য। হযরত মা আয়শা (রা.) নবীয়ে কারীম (স.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল আমরা মনে করি জিহাদই সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। তাহলে আমরা (নারীরা) কি জিহাদ করব না? নবীজী (স.) ইরশাদ করলেন, তোমাদের জন্য হজ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ জিহাদ। (বোখারী শরীফ ১/২০৬ পৃ.)।
সুতরাং হজ ফরজ হলে নারী-পুরুষ সকলকেই বিলম্ব না করে আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাওয়া অপরিহার্য। অলসতা কিংবা আল্লাহর বিধানের প্রতি অনিহা প্রকাশ করত হজ করা থেকে বিরত থেকে যদি মৃত্যু মুখে পতিত হয়ে যায়, তাহলে তার পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। নবীজী (স.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার ব্যয়-নির্বাহের মালিক হওয়া সত্যেও হজ না করে তবে সে ইয়াহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করবে বা খ্রিস্টান হয়ে, উভয়টিই তার জন্য বরাবর। (তিরমিযী শরীফ-১/১৬৭ সুনানে দারিমী, কিতাবুল-মানাসিক)।
হজ কার উপর ফরজ?
অন্যান্য ইবাদতের মতো হজ ফরজ হওয়ার জন্যও রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু শর্ত, তন্মধ্যে আবার এমন কিছু শর্ত রয়েছে যার অবর্তমানে হজ সহীহ হবে না- যেমন- ১. মুসলমান হওয়া। ২. সুস্থ্য বিবেকসম্পন্ন হওয়া, সুতরাং বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তির উপর হজ ফরজ নয়। ৩. বালেগ তথা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। ৪. হজের স্থান-মক্কা মোকাররমায় যাওয়ার সামর্থ্য থাকা। এ শর্তটির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে যা বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো। পুরুষের উপর হজ ফরজ হবে দু'ধরনের সামর্থ্য থাকলে-(ক) আর্থিক সামার্থ্য। (খ) শারীরিক সামর্থ্য।
আর্থিক সামর্থ্য
যাদের ব্যয়ভার বহন করা ওয়াজিব, হজে যাওয়ার সময় থেকে আরম্ভ করে হজ হতে ফিরে আসা পর্যন্ত তাদের প্রয়োজনীয় খোরপোষের ব্যবস্থা করা ও নিজস্ব কোন ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করার পর হজের স্থান পর্যন্ত যাওয়া ও হজের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা যদি সম্ভব হয় তাহলে শরিয়াতের দৃষ্টিতে তাকে বলা হবে আর্থিক সামর্থ্যবান ব্যক্তি।
শারীরিক সামর্থ্য
মক্কা মোকাররমা ও মদীনা মানাওয়ারাহ পর্যন্ত যাতায়াত এবং হজের যাবতীয় কার্যাদী পালনে অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজের উপর পূর্ণ আস্থাশীল হওয়া। একথাতো স্পষ্টই যে রুগ্ন ব্যাধিগ্রস্ত, দুরারোগ্য আক্রান্ত, চলাফেলায় অক্ষম ও শারীরিক ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তি এতো বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি শরয়ী বিধান পালন করবে কি করে? অথচ বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ থেকে নিয়ে নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা জিয়ারত পর্যন্ত সবকটি ক্ষেত্রেই রয়েছে সীমাহীন মুশাককাত ও অবর্ণনীয় কষ্ট ক্লেশ। তাই ইসলামের এ মহান ইবাদতটির শুদ্ধ হওয়ার জন্য শারীরিক সামর্র্থ্য একান্তই আবশ্যক।
নারীর উপর হজ ফরজ হবে তিন ধরনের সামর্থ্য থাকলে
ক. আর্থিক, খ. শারীরিক, গ. মাহরাম বিষয়ক।
সুতরাং নারী, আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান হলেই চলবে না বরং তার সাথে তার কোন মাহরাম আত্মীয় থাকতে হবে তবেই তার উপর হজ ফরজ হবে।
শুধু আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান নারীর ক্ষেত্রে হজ ফরজ হয়েছে বলে বিবেচিত হলে শারীরিক অসামর্থ্য বা মাহরাম সাথে না থাকার কারণে নিজে গিয়ে ঝামেলা না করে বরং অন্যকে দিয়ে বদলী হজ করিয়ে নিবে।
আর কেবল শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান নারীর উপর হজ ফরজ নয়। তবে কোনভাবে হজে গিয়ে হজ করে ফেললে হয়ে যাবে। কিন্তু মাহরাম না থাকার দরুন কঠিন গুনাহ হবে।
তদরূপ পুরুষের বেলায়ও আর্থিক সামর্থ্য আছে কিন্তু শারীরিক নেই তাহলে এ ক্ষেত্রে অন্যকে দয়ে বদলি হজ করিয়ে নিলেই হজের ফরজ আদায় হয়ে যাবে।
হজে যাওয়ার আগে করণীয়
১. অনুমতি প্রসঙ্গ :-
হজ ফরজ হয়ে থাকলে স্বামীর অনুমতি নেয়া মুস্তাহাব। ফরজ কাজে অবশ্যই স্বামীর পক্ষ থেকে বাধা আসবে না তথাপিও যদি স্বামী বাধা প্রদান করেই তাহলে মাহরাম সাথী পেয়ে গেলে অবশ্যই স্ত্রীকে ফরজ হজ আদায় করতে সফরে বেড়িয়ে পড়তে হবে। অন্যথায় স্বামী-স্ত্রী উভয়েই গুনাহগার হবে।
হ্যাঁ, যদি কোন নারী নফল হজ করতে ইচ্ছে পোষণ করে তাহলে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। মাহরাম সাথী পাওয়া গেলেও স্বামীর অনুমতি ছাড়া নফল হজ করতে যাওয়া জায়েয নেই। বরং এ ক্ষেত্রে স্বামীও তার অধিকার বলে স্ত্রীকে নফল হজের জন্য সফরে যেতে বাধা প্রদান করতে পারবে। (মাজমুউল ফাতওয়া ৮/৩৫ পৃ., আল মুগনী- ৫/৩৫, ফাতওয়ায়ে শামী ৩/৪৬৫ পৃ.)।
এক্ষেত্রে আরো একটি কথা স্মরণ রাখা বাঞ্ছনীয় যে, ফরজ হজ বা ফরজ ইবাদত করার থেকে যেখানে স্বামীও বাধাদান করতে পারে না বরং বাধা প্রদান করা হলেও উপেক্ষা করে ফরজটি আদায় করে নেয়া আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে পিতা-মাতা তো সাবলিকা মেয়েকে যখন মাহরাম সাথী মিলে যায় বাধা দেয়ার অধিকারই রাখে না।
মাহরাম কেউ সাথে থাকা
শুধু হজ-ই নয় বরং যে কোন সফর (যা তিন মাইল বা তিন দিনের দূরত্বের হবে) নারীদের জন্য একাকী করা বৈধ নয়। সাথে মাহরাম কেউ থাকা একান্ত অপরিহার্য। আর হজ তো অনেক দূরের সফর, অধিকন্তু নারীর উপর হজ ফরজ হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে মহরাম সাথে থাকা। (শামী-৩/৪৬৫ পৃ.)।
এ ক্ষেত্রে যুবতী-বৃদ্ধা, সুন্দরী-কুশ্রীর মাঝে কোন পার্থক্য নেই। ঠিক তদরূপ সফর চাই আকাশজানে হোক কিংবা নৌজানে, গাড়ি-ঘোড়ায়, লঞ্চ-স্টিমারে বা পদব্রজে সর্বাবস্থায় মাহরাম সাথে থাকা অত্যাবশ্যক। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি রাসূলে করীম (স.) কে ইরশাদ করতে শুনেছি :
কোন নারী মাহরাম ছাড়া যেন সফর না করে, অনুরূপভাবে মাহরামের অনুপস্থিতিতে কোন পুরুষ যেন কোন নারীর ঘরে প্রবেশ না করে। এ কথাশুনে একজন সাহাবী আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর' রাসূল আমি অমুক যুদ্ধে যেতে চাই অথচ আমার স্ত্রী হজে যেতে ইচ্ছুক। নবীজী (স:) ইরশাদ করলেন তুমি তোমার স্ত্রী সাথে হজের সফরে বের হয়ে যাও। (বোখারী শরীফ ১৭২৯ নং হাদীস পৃ. ১/২৫০, মুসলিম শরীফ ১৩৪১ নং হাদীস পৃ.- ১/৪৩৪)।
মাহরাম কি ও কারা?
শরীয়তের পরিভাষায় মাহরাম ঐ সকল আত্মীয়-স্বজন যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া স্থায়ীভাবে হারাম। সকল মাহরাম আত্মীয়-স্বজনদেরকে মোট তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
(ক) বংশগত মাহরাম
বংশগত মাহরাম মোট সাত প্রকার। যথা-
১. নারীর পিতৃকূল : যেমন- পিতা, দাদা, নানা, পারদাদা, পরনানা এবং তদূর্ধ্ব পিতৃপুরুষেরা। ২. নারীর ছেলের সন্তান : যেমন- পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যার পুত্র তদনিম্ন ছেলেরা। ৩. নারীর ভাই : আপন ভাই, বৈপিত্রেয় ভাই ও বৈমাত্রেয় ভাই। ৪. নারীর চাচা : আপন চাচা, বৈপিত্রেয় চাচা ও বৈমাত্রেয় চাচা, অথবা কোন নারীর মা-বাবার চাচা। ৫. নারীর মামা : আপন মামা, বৈপিত্রেয় মামা, বৈমাত্রেয় মামা এবং নারীর পিতা মাতার মামা। ৬. ভাইয়ের ছেলে, ভাইয়ের ছেলের ছেলে, ভাইয়ের ছেলের কন্যাদের ছেলে ও তদনিম্ন ছেলেরা। ৭. বোনের ছেলে, বোনের ছেলের ছেলে, বোনের ছেলের কন্যাদের ছেলে ও তদনিম্ন ছেলেরা।
(খ) দুগ্ধপানজনিত মাহরাম
দুগ্ধপানজনিত মাহরামও বংশগত মাহরামের ন্যায় সাত প্রকার হতে পারে যার বিবরণ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ বংশগত কারণে যারা হারাম দুগ্ধপানজনিত কারণেও তারা হারাম হবে। সুতরাং জন্মদাতা হিসেবে পিতা যেমন হারাম, কোন নারী কাউকে স্তন্যপান করালে তার স্বামী ঐ দুধপানকারী মেয়ের জন্য দুগ্ধপিতা হিসেবে হারাম। এভাবে উপরে বর্ণিত সকল আত্মীয়ই দুগ্ধপানজনিত কারণে হারাম হবে এবং নারী হলে পুরুষ আত্মীয়গণ মাহরাম হিসেবে ভূষিত হবে।
(গ) বৈবাহিক সম্পর্কজনিত মাহরাম
এ প্রকার মাহরাম চার ধরনের হতে পারে।
১. স্বামীর পুত্র : তাদের পুত্রের পুত্র, কণ্যার পুত্র এবং তদনিম্ন পুত্রেরা। ২. স্বামীর পিতা : দাদা, নানা এবং তদূর্ধ্ব পুরুষেরা। ৩. কন্যার স্বামী : পুত্রসন্তানের মেয়ের স্বামী, কন্যা সন্তানের মেয়ের স্বামী এবং তদনিম্ন মেয়েদের স্বামীগণ। ৪. মায়ের স্বামী এবং দাদী বা নানীর স্বামী। (আল কোরআন সুরা নিসা : আয়াত নং-২৩। ফাতায়ায়ে শামী- ৪/৯৯-১০৫ ফাতায়ায়ে আলমগীরী-১/২৭৩-২৭৭ আল বাহরুর রাইক- ২/৯২-৯৫)।
এরা সকলেই মাহরাম, এদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া চিরকালের জন্য হারাম। তাই এদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ, মুখোমুখি কাথা-বার্তা এবং এদেরকে সাথে নিয়ে সফরে বের হওয়া সম্পূর্ণই বৈধ।