বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

মিরাজুন্নবীর (সা.) তাৎপর্য ও শিক্ষা

জাস্ট নিউজ
-এম জহিরুল ইসলাম
মুসলিম জীবনে পবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ রজনীর মধ্যে লাইলাতুল মিরাজ অন্যতম। এটি বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী ও বিশ্বের সর্বপ্রথম নভোচারী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়তি জীবনের সবচেয়ে বড় একটি মুজিযা। এটি সংঘটিত হয়েছিল নবুয়াতের দ্বাদশ বছরের ২৬ রজব রাতে। অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.)-এর ৫২ বছর বয়সে ৬২১ খ্রিষ্টাব্দে। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদকে (সা.) জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে বাইতুল মুকাদ্দাস হয়ে সপ্ত আকাশ, আরশে আজিম এবং তদূর্ধ্বেও আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী বিশেষ বিশেষ স্থান পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন।

কুরআনের ভাষায়, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাহকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই।' (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ১)।

কুরআন ও হাদিসে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে মিরাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা হলো-

২৬ রজব রাত্রি। নবীজী (সা.) উম্মে হানীর ঘরে শুয়ে ছিলেন। এমন সময় জিব্রাইল (আ.) এসে তাকে নিয়ে কাবার হাতিমে চলে গেলেন। সেখানে তার বক্ষ বিদীর্ণ করা হয়। এরপর নবীজীকে (সা.) বুরাকের পিঠে চড়িয়ে মসজিদে আকসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখেন সব নবী-রাসুল তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি সেখানে সবার ইমাম হয়ে দু'রাকাত নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে জিব্রাইল (আ.) তাকে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে চলেন। সেখানে আকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।

অতঃপর তিনি ‘সিদরাতুল মুনতাহায়' যান যেখানে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে স্বর্ণের প্রজাপতি এবং বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি ছোটাছুটি করছিল। আর ফেরেশতারা স্থানটিকে ঘিরে রেখেছিল। সেখানেই তিনি একটি দিগন্তবেষ্টিত সবুজ রঙের ‘রফরফ' দেখতে পান। সে রফরফে চড়ে অবশেষে উচ্চতার সর্বশেষ পর্যায়ে পৌঁছে মহান আল্লাহর দিদার লাভ করেন। এ ছিল মিরাজের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

 

প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক যে, রাসূল (সা.)-এর এ মিরাজ কেন সংঘটিত হয়েছে বা এর তাৎপর্য কী? এ প্রশ্নের উত্তরে ইসলামী চিন্তাবিদদের বিশ্লেষণটা এ রকম, শৈশবকাল থেকেই দুঃখ-কষ্ট, স্বজন হারানোর বেদনা নবীজীর পিছু ছাড়ছিল না। একটার পর একটা লেগেই থাকত। জীবনের এক পর্যায়ে এসে হযরত খাদিজা (রা.) এবং তার একমাত্র আশ্রয়দাতা চাচা আবু তালিবকে হারিয়ে তিনি খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তার এ অসহায়ত্বের সুযোগে কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূল (সা.) হযরত যায়েদকে (রা.) সঙ্গে নিয়ে আশ্রয় লাভের জন্য তায়েফে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তায়েফবাসীর নির্মম অত্যাচার ও প্রস্তুরাঘাতে জর্জরিত হয়ে বিষণ্‌নচিত্তে ক্লান্তশ্রান্ত দেহে তায়েফ থেকে ফিরে আসেন। এ কঠিন বাস্তবতার সময়ে আল্লাহ তায়ালা তাওর প্রিয় হাবীবকে সান্তনা দেয়ার উদ্দেশ্যে নিজের কাছে নিয়ে যান।

মিরাজের রজনীতে মহানবী (সা.) আল্লাহর দিদার লাভ করতে গিয়ে স্বচক্ষে আরশ কুরসি, লওহে কলম, পুলসিরাত, বেহেশত, দোজখ ইত্যাদি দর্শন করে আইনুল ইয়াকীন অর্জন করেন। এ রজনীতেই মহানবী (সা.) ভবিষ্যৎ ইসলামী রাষ্ট্রের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা লাভ করেন। এর ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই রাসূল (সা.) পরে মদিনায় হিজরত করে স্বীয় দর্শনলব্ধ জ্ঞান ও আল্লাহর নির্দেশের আলোকে ইসলামের প্রদীপ্ত শিখা জ্বেলে দিলেন। সেই আলোতেই মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে সমগ্র বিশ্ব আলোকিত হয়েছিল।

এ ছাড়াও মিরাজের রাতে রাসূলকে (সা.) উপঢৌকন হিসেবে তিনটি জিনিস প্রদান করা হয় বলে এ রাতের তাৎপর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ তিনটি জিনিস হলো- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, সূরা বাকারার শেষ তিন আয়াত এবং শিরক ছাড়া সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়ার সুসংবাদ।

মিরাজের শিক্ষা: মিরাজের ঘটনা থেকে আমরা কিছু শিক্ষা অর্জন করতে পারি। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচিত হলো-

১. মিরাজের প্রথম শিক্ষা মারিফাত সম্পর্কীয়। আমাদের নবী করিম (সা.) আল্লাহর দিদার এবং সান্নিধ্য লাভ করে মারিফাতের শীর্ষে পৌঁছেন। কিন্তু এ মারিফাতের জ্ঞান অর্জন করে তিনি আমাদের মতো (তথাকথিত আশেকে রাসূলের মতো) দেওয়ানাও হলেন না, মাজনুনও হলেন না এমনকি তন্দ্রাগ্রস্তও হলেন না। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অব্যাহত রাখার জন্য নিজের বাকি জীবনকেও কুরবান করে দিলেন।

২. আগে মহানবী (সা.) যে কাজ করতেন না মিরাজ থেকে ফিরে এসে তিনি সেই কাজও শুরু করলেন। ফিরে এসে কয়েক দিন পরই তিনি মদিনায় হিজরত করলেন এবং কায়েম করলেন এক কল্যাণধর্মী ইসলামী রাষ্ট্র। মিরাজের রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর হাবীবকে শুধু দীন ইলম নয়, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিও শিক্ষা দিয়েছিলেন।

৩. মিরাজের তৃতীয় শিক্ষা হলো, সমাজ ও সমষ্টিচেতনা। মহানবী (সা.) অনেক ওপরে উঠেও সেখানে থাকেননি। তিনি মাটির পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন শুধু ঘর থেকে বিতাড়িত হতে, বারবার আক্রান্ত হতে, আহত হতে, নিজের দাঁত ভাঙতে। এর কারণ তাঁর মধ্যে ব্যক্তিচেতনার চেয়ে সমষ্টিগত চেতনা ছিল বেশি। তিনি একা থাকতে চাননি। দুনিয়ায় ফিরে এসে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে আমাদের জন্য অনুকরণীয় এক অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন।

৪. মিরাজের চতুর্থ শিক্ষা হলো ‘আমালুস সালিহ' বা কল্যাণমূলক কাজ। আল্লাহ রাসূল (সা.) মিরাজ থেকে ফিরে এসে মদিনায় হিজরত করে কল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। যুবকদের তিনি তার দিকে আকৃষ্ট করেছিলেন জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে।

৫. মিরাজের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রধান শিক্ষা হলো মুসলমানদের বিজ্ঞানচর্চার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান। মহানবী (সা.) আল্লাহর কুদরতে নভোমণ্ডল বিচরণ করেছেন এবং আমাদের সামনে আলোকবর্তিকা হিসেবে বিরাজমান। আল্লাহ তায়ালা নবীজীকে নভোমন্ডল ভ্রমণের যে ফর্মুলা দিয়েছেন তা হলো মারিফাত ফর্মুলা। ওই ফর্মুলা মানুষের জন্য সম্ভাবনাময়। মানুষকে বুদ্ধি-বিবেচনা-গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চা করে এলমে মারিফাত অর্জন করে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।

মিরাজ প্রমাণ করে যে, মানুষ গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে যে উপগ্রহ বা চাঁদে যেতে পারে তা নয় বরং গ্রহ, নক্ষত্র জড় জগৎ পার হয়ে সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করে আরো ঊর্ধ্বে যেতে পারে। নভোমন্ডল ও তদূর্ধ্ব ভ্রমণ হবে আমাদের নবীরই সুন্নাত। তাই লাইলাতুল মিরাজের তাৎপর্য ও শিক্ষা অনস্বীকার্য।

লেখক: আলেম, সাংবাদিক।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

বায়তুল্লাহ জিয়ারত ও হজ
প্রকৃত রোজা ও সংযমের কিছু ...
গীবত ও চুগলখোরীর ভয়াবহ পরিণাম
সফরে কসর ওয়াজিব
হজ্বঃ মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ ...
হজ্ব: বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সোপ
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক
হাজিদের উদ্দেশ্যে ইরানের ...
মিরাজুন্নবীর (সা.) তাৎপর্য ও ...
দাসত্ব-উবুদিয়্যাহ

 
user comment