রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? তোমরা নিশ্চয়ই ইরানের বিখ্যাত কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবীর নাম শুনেছো। মসনবী এমন এক অনন্য সাধারণ গ্রন্থ যা আজও তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য এবং আধুনিকতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে৷ আটশ বছর আগের এই গ্রন্থে কল্পনাভিত্তিক গল্প, রূপকধর্মী গল্প, রহস্যময় গল্প, আধ্যাত্মিক গল্প, শিক্ষণীয় গল্প, নৈতিক বা চারিত্রিক গল্প রয়েছে৷
মাওলানা রুমী সবসময় দুর্লভের পেছনে ছুটেছেন৷ ছুটে ছুটে যা কিছু তিনি পেয়েছেন তা-ই তিনি শ্রোতা বা পাঠকদের জন্যে নিজস্ব স্টাইলে বর্ণনা করেছেন৷ সে জন্যেই তাঁর গল্পগুলো হয়ে উঠেছে তাঁর মূল দর্শন, চিন্তা, শিক্ষা বা প্রজ্ঞা প্রকাশের বাহন৷ তিনি গল্প লেখার মাধ্যমে বিশেষত নৈতিক শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেছেন৷ আজকের আসরে মাওলানা রুমী মসনবী থেকে কয়েকটি গল্প শোনাব। আর গল্প শেষে থাকবে একটি গান।
মাওলানা রুমীর মসনবীতে পাখিদের বিচিত্র এবং বিস্ময়কর ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। পাখির স্বাভাবিক যে বৈশিষ্ট্য মৌলাভি সেগুলোকেই ব্যবহার করেছেন। যেমন পাখিদের পাখা-পালক,পাখিদের গান গাওয়া,পাখিদের সৌন্দর্য, তাদের উড়াল, পাখির বাসা, খাঁচায় বন্দী থাকা এবং দলবদ্ধভাবে পাখিদের ভ্রমণ করা ইত্যাদি অনুষঙ্গই মৌলাভি তাঁর রচনায় ব্যবহার করেছেন। মৌলাভি তাঁর জটিল চিন্তা ও তাঁর আদর্শগুলো বর্ণনার ক্ষেত্রে বিচিত্র পাখির ব্যবহার করেছেন। মৌলাভি পাখির উড়াল থেকে আকাশ এবং জমিন, ফেরেশতা এবং উর্ধ্বজগত ইত্যাদিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। প্রথমেই তোতা পাখিকে নিয়ে একটি গল্প শোনা যাক--
এক মুদি দোকানদারের একটি সুকণ্ঠী তোতা পাখি ছিল৷ সেই তোতা পাখিটি মানুষের ভাষা খুব ভালোভাবেই জান তো৷ দোকানের প্রহরী এবং ক্রেতাদের সাথে সে কথা বলতো৷ একদিন দোকানদার বিশ্রামের উদ্দেশ্যে বাসায় গেল এবং যথারীতি তোতা পাখিটি একাকী দোকানে ছিল৷ হঠাৎ একটা বিড়াল ইঁদুর ধরার জন্যে দোকানের ভেতরে ঢুকলো৷ তোতা পাখিটি বিড়ালকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷ সে একেবারে কোণায় গিয়ে পালাতে চেয়েছিল আর অমনি বাদাম তেলের বোতলগুলোতে বাধাগ্রস্ত হয় আর বোতলগুলো নীচে পড়ে যায়৷ দোকানদার যখন ফিরে এসে দেখলো যে সারা দোকানে তেল আর তেল,ভীষণ রেগে গেল এবং তোতার মাথায় আঘাত করে৷ আঘাত পেয়ে তোতার মাথাটা ন্যাড়া হয়ে যায়৷ ফলে তোতা পাখিটি চুপচাপ দোকানের এক কোণে গিয়ে বসে থাকে৷
তোতা পাখির এই নীরবতায় দোকানদার ভীষণ কষ্ট পেল৷ সে তোতার কথা খুবই উপভোগ করত৷ এখন পাখির কণ্ঠ রোধ হয়ে আসায় নিজের কাজের জন্যে অনুতপ্ত হল৷ দোকানদার আগের অবস্থায় ফিরে যাবার চেষ্টা করল৷ কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না৷ অগত্যা চুপ মেরে গেল৷ এমন সময় ন্যাড়া মাথার এক তাঁতের কারিগর দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল৷ তাকে দেখেই তোতা পাখিটি বলে উঠলো-তুই কেন ন্যাড়া? তুইও কি তেলের বোতল ভেঙ্গেছিস? মানুষ তোতার এ রকম মজার কথা শুনে হাসল৷
বন্ধুরা, তোতা পাখির পর এবার যে গল্পটি শোনাব তা বাজপাখি নিয়ে।
একটা শিকারী বাজপাখি সবসময় রাজকীয় অতিথি ছিল। একদিন সে তার পথ হারিয়ে গিয়ে হাজির হয় এক বিরান ভূমিতে। সেখানে বাস করতো পেঁচার দল। পেঁচার দল শিকারী বাজপাখিকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই ভয়ে একটু চমকে গিয়েছিলো। পরে ঈর্ষাপরায়ন হয়ে বললো, এই বাজপাখি অবিবেচকের মতো এখানে এসেছে আমাদের স্থান দখল করতে,আমাদেরকে আমাদের বাসা থেকে উচ্ছেদ করতে। পেঁচারা তাই বাজপাখির ওপর হামলা করলো এবং নোংরা কথাবার্তা বললো।
বাজপাখি পেঁচাদের মাঝে পড়ে ভীষণভাবে অস্বস্তি বোধ করছিল। তাই সে চিৎকার করে বললো-‘এই বিরান প্রান্তরে পেঁচাদের সাথে কেন আমি? আমি তো রাজপ্রাসাদে বাস করি।' এরপর পাখিটি বলল- "হে পেঁচার দল, তোমরা দুঃখিত হয়ো না। আমি এই অপরিচিত প্রান্তরে থাকতে আসিনি। আমি আমার গন্তব্য রাজপ্রাসাদের দিকে যাবো। এই ফালতু প্রান্তর যা তোমাদের দৃষ্টিতে মহামূল্যবান, আমার কাছে এর মূল্য অতি সামান্য। আমার যেহেতু রাজপ্রাসাদে সবসময়ই স্থান রয়েছে, সেহেতু আমি এই গুহার মধ্যে বসবাস করতে স্বস্তি বোধ করবো না। ফলে তোমরা দুশ্চিন্তা করো না, আমি এই নোংরা জায়গা থেকে অবশ্যই চলে যাবো।" কিন্তু পেঁচার দল বাজপাখির কথা বিশ্বাস করতে পারল না। তারা ভাবলো-এটা নতুন আরেকটা ফন্দি। রাজপ্রাসাদে বসবাস করা,রাজকীয় লোকজনের সাথে চলাফেরা করা ইত্যাদি বক্তব্য আমাদেরকে ভয় দেখানো এবং আমাদের বাসা দখল করার পাঁয়তারা মাত্র। আমাদেরকে ভড়কে দেওয়ার জন্যেই এসব বলা হচ্ছে। তা না হলে একটা বাজপাখিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার মতো এমন কী ঠেকা পড়েছে বাদশাহদের।
এ রকম একটা বাজপাখির এ ধরনের কথাবার্তা কেউই বিশ্বাস করবে না। সে যে বলছে বাদশাহ এখন তার সৈন্য সামন্তকে তার খোঁজে পাঠিয়েছে, এগুলো মিথ্যা,চালবাজি ছাড়া আর কিছু না। যে এই বাজপাখির কথা বিশ্বাস করবে সে বোকার হদ্দ। বাজপাখির মতো সাধারণ একটা পাখির এমন কী কদর থাকতে পারে বাদশাহী মহলে!
বাজ পাখি চাচ্ছিলো পেঁচাদেরকে তাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতা থেকে মুক্তি দিতে। এই লক্ষ্যে সে পেঁচাদেরকে বললো-অহঙ্কার করো না। আমার একটি পালক যদি ভাঙ্গে, তাহলে আমার মালিক তোমাদের এই বাসভূমিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। আমার স্বগোত্রীয় কেউ যদি আমাকে বিরক্ত করতে চাইতো,তাহলেও বাদশাহ তার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে হাজার হাজার বাজপাখিকে মেরে ফেলতো। কেননা তাঁর অন্তরে আমার একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। আমি যেখানেই যাই না কেন তিনি আমার সাথে সাথে রয়েছেন। তিনি আমাকে আকাশে ওড়ালে আমি দিগন্তের পর্দা ভেদ করে আকাশে উড়ি। কারণ আমি হলাম বাজপাখি। আমার আকাশে ওড়া দেখে বিশাল পাখি হোমাও আশ্চর্য হয়ে যায়। আর সামান্য পেঁচা তো ছাই। তারা কী করে আমার মর্যাদা বা আমার গুরুত্ব উপলব্ধি করবে?
পেঁচাদের দিকে তাকিয়ে বাজপাখি আরও বললো,সেই পেঁচাটিই সৌভাগ্যবান যে আমার আকাশের ওড়ার রহস্য নিয়ে ভাবে এবং আমার মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারে। যদি এ বিষয়টি বুঝতে পারতে যে বাদশাহর সাথে যার সম্পর্ক রয়েছে সে যেখানেই থাকুক না কেন, অবাঞ্চিত নয়, কিংবা অপরিচিত নয়। যে-ই তার ব্যথা নিরাময়ের জন্যে তাঁর অনুগ্রহ বা দয়া লাভ করে,সে বাঁশির মতো কৃশদেহ হলেও অক্ষম নয়। এ কথা সত্য যে আমি বাদশার গোত্রের কেউ নই, আমি কেবল তাঁর এক প্রিয় শিকারী পাখি। তিনি মহামান্য। আমি কিচ্ছু না। কিন্তু বাদশাহর ভালোবাসার কারণে এবং আমি তাঁর খেদমত করার কারণে তিনি তাঁর মহান মর্যাদাবান কৃপা দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকালেন, আর আমি তাঁর সেই অনুগ্রহে এই মর্যাদা বা সম্মানে ভূষিত হয়েছি।
বাজপাখি এই গল্পে ইনসানে কামেল এবং আল্লাহর নবীর রূপক। আর পেঁচা হলো দুনিয়া পূজারী অর্থাৎ যারা আল্লাহর সাথে বা আল্লাহর অলিদের সাথে শত্রুতা করে সেইসব মানুষের রূপক। বাদশাহ হলো আল্লাহ বা সত্যের প্রতীক। মৌলাভি এই গল্পের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে পেঁচারাও যদি বাজপাখির মতো আল্লাহর ভালোবাসা পাবার জন্যে তাঁরি খেদমতে বিনীত থাকতো তাহলে পেঁচারাও বাজপাখির মতো মর্যাদাবান হতে পারতো।
বন্ধুরা, পাখি নিয়ে গল্প শোনার পর এবার আমরা মাছ নিয়ে একটি গল্প শোনাবো।
একটি পুকুরে সুন্দর এক বড়োসড়ো তিনটি মাছ বাস করতো। একদিন ক'জন মাছ শিকারী ঐ পুকুরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের নজর পড়লো সুন্দর ঐ মাছগুলোর ওপর। কিন্তু শিকার করার মতো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তাদের কাছে তখন ছিলো না। তাই তারা শিকারের সরঞ্জাম নিয়ে পরে আসবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। মাছগুলো কিন্তু শিকারীদের কথাবার্তা শুনে ফেলেছিলো। তাই ভাবলো গড়িমসি করলে শিকারীদের ফাঁদে পড়তে হবে। অতএব একটি বুদ্ধি খুঁজে বের করতেই হবে।
তিনটি মাছের মধ্যে একটি ছিল বুদ্ধিমান এবং দূরদর্শী চিন্তার অধিকারী। একটি ছিল মোটামুটি বুদ্ধিমান আর তৃতীয়টি ছিল মূর্খ,বোকা,সময়ক্ষেপনকারী এবং অলস প্রকৃতির।
বুদ্ধিমান মাছটি মনে মনে বললো সময় থাকতে থাকতেই এই বিপদ থেকে প্রাণটা নিয়ে বিশাল সমুদ্রে পালাতে হবে। সে তার এই সিদ্ধান্তটি অপর দুই মাছের কাছ থেকে গোপন রাখতে চাইলো। কেননা তারা যদি জানতে পারে তাহলে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তারা তাকে ছেড়ে যেতে পারে। তাই সে অন্যদেরকে কিছু না বলেই পাড়ি জমালো এবং বিপদ-সঙ্কুল সূক্ষ্ম পথ ধরে মুক্ত সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছলো। নিজের বিপদের আঁধারকে আলোকের সমুদ্রে নিয়ে গেল।
দ্বিতীয় যে মাছটি অর্ধ বুদ্ধিমান বা মোটামুটি বুদ্ধিমান ছিল,সে যখন শিকারীদের দেখতে পেলো,বুঝলো যে সে অলসতা করেছে এবং শিকারীদের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। তাই নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিলো এইজন্যে যে কেন বুদ্ধিমান মাছটির সাথে পাড়ি জমালো না। ভাবতে ভাবতে দেখলো এখনো যেটুকু সুযোগ রয়েছে তা-ও ভেবে ভেবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অতএব এখন রাগের সময় নয়। বরং মুক্তির একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যা হাতছাড়া হয়ে গেছে,তা তো গেছেই, পুনরায় তা ফিরে আসবে না। এইবলে সে ভাবলো,মরার ভান করে নিঃসাড়ভাবে চিৎ হয়ে যাবে এবং শ্রোতের মাঝে নিজেকে ভাসিয়ে দেবে,যাতে শিকারীরা ভাবে সে মরে গেছে,ফলে তাকে শিকার করবে না।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। শিকারীরা মাছটিকে মৃত মনে করে পানি থেকে তুলে নিয়ে পুকুর পাড়ে ফেলে রাখলো। শিকারীরা দূরে সরে যাবার পর মাছটি পুনরায় পুকুরে নেমে প্রাণ বাঁচালো। তবে তৃতীয় মাছটি যে কিনা বোকা,অলস এবং সময় ক্ষেপনকারী ছিল,সে তার সামনে বিপদ দেখতে পেয়ে অস্থির হয়ে গেল। ভয়ে সে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে প্রাণে বাঁচতে চাইলো। কিন্তু কাজ হলো না,শিকারীর ফাঁদে তাকে পড়তেই হলো। ফাঁদে পড়ে সে মুক্তির আশায় জালের এ ফোঁড় ও ফোঁড়ে দৌড়ালো। কিন্তু যতোই সে দৌড়ালো ততোই আহত হলো,ততোই ক্লান্ত হলো,ততোই ফাঁদে বেশি করে আটকা পড়লো। শিকারীরা তাকে ধরে নিয়ে কাবাব বানিয়ে খেলো। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মাছটি মনে মনে বললো এইবার যদি এই ফাঁদ থেকে কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে যাই তাহলে আর ভুল করবো না,সোজা সমুদ্রে গিয়ে নিরাপদ জীবন যাপন করবো। নিজে যদি নাও পারি তাহলে বুদ্ধিমানদের হাত ধরে এবং তাদের নির্দেশনায় বিপদ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজবে। কিন্তু সেই সুযোগ তার আর হলো কই!
এই গল্পে মৌলাভি আমাদের শিখিয়েছেন পুকুরের মতো ছোট্ট এবং বিপদ সঙ্কুল এই পৃথিবীতে অলসতা করা যাবে না। সচেতন হতে হবে। আল্লাহকে ভয় করতে হবে। কর্মতৎপর হতে হবে। চোখ বুজে ঘুমালে চলবে না। দ্রুত পায়ে দৌড়তে হবে সমুদ্রের দিকে,প্রেমের কুল-কিনারাহীন সমুদ্রের দিকে,ভালোবাসা ও মানবতার দিকে,মুক্তির দিকে। এই পথে যা কিছু চলে গেছে বা হারিয়ে গেছে তার জন্যে ভাবলে চলবে না,কেননা যা কিছু চলে গেছে তা আর ফিরে আসবে না।#